নিঃস্বার্থ প্রেম
৪০ বছরের বিবাহিত জীবন। সম্পর্কের বন্ধন তবুও অটুট। বয়সের সাথে সাথে কুন্তলবাবু স্মৃতিশক্তি হারিয়েছেন অনেকটাই। অতীতের অনেক কথাই এখন আর মনে থাকে না। একবার শুনলে বা কেউ ধরিয়ে দিলে আবার মনে পড়ে সব কিছু।
স্ত্রী রমাদেবী কিছু কথা একটি ডাইরিতে লিখে রাখেন। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফোন নম্বর, ওষুধ খাওয়ার সময়, আরও মনের কিছু কিছু গুপ্ত কথা যেগুলো তিনি এখনও পর্যন্ত বলে উঠতে পারেন নি। মাঝে মধ্যেই কুন্তলবাবু লুকিয়ে লুকিয়ে সেই লেখাগুলো পড়েন আর আর স্ত্রী রমাদেবীকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করেন।
রবিবার সকাল বেলায় বাজার করা নিয়ে স্বামী -স্ত্রী এর মধ্যে হয়ে গেল তুমুল ঝগড়া। কুন্তলবাবু চেয়েছিলেন নিজেই বাজার করতে যাবেন। কিন্তু কয়েকদিন ধরে ওনার প্রেসারটা একটু বেড়েছে। তাই রমাদেবী বারণ করলেন বেরোতে। ব্যস শুরু হল বাকবিতন্ডা।
চিৎকার চেঁচামেচি, শেষে ছেলে বিজয়, পুত্রবধূ রীনা, নাতি সাহেব এসে ঝগড়া থামানোর চেষ্টা করতে থাকে। অনেকক্ষণ পর সকলের প্রচেষ্টায় উভয়পক্ষ শান্ত হলেও মনের আকাশে তখন ও কালো মেঘের ঘনঘটা।
বাড়ির পরিবেশ থমথমে। কুন্তলবাবু, রমাদেবী কেউ কারুর সাথে কোনো কথা বলছেন না। আলাদা আলাদা ঘরে ঢুকে দরজায় খিল এঁটেছেন দুজনেই। এরকম ঝগড়া খুব একটা হয় না দুজনের মধ্যে। বিজয় ও রীনা অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে দুজনকে, বড় মেয়ে কল্পিতা ও ফোন করেছিল মাকে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। এটা বোধহয় বয়সের দোষ। দুজনেই খুব অভিমানী।
কুন্তলবাবুর সারা শরীর কাঁপছে। এরকমটা ওনার সেই ছোট বেলা থেকেই হয়। খুব কষ্ট হলে নিজে থেকেই সমগ্র শরীর কাঁপতে থাকে আর দু চোখ ভিজে যায় জলে। এবারেও তাই হল। রমা -এর জীবনে কি সত্যিই ওনার কোনো জায়গা নেই। ওনার ইচ্ছা আকাঙ্খার কি কোনো মূল্য নেই রমাদেবীর কাছে। এসব ভাবতে ভাবতে বার বার চোখের জল মুছতে লাগলেন।
মনের রাগ অনেকক্ষণ আগেই প্রশমিত হয়েছে। আগের থেকে মন টা অনেকটাই শান্ত হয়েছে। কিন্তু কিভাবে স্ত্রী-এর মানভঞ্জন করবেন সেই উপায়ের কথাই চিন্তা করছিলেন।
হঠাৎ কি মনে হতে বিছানার পাশে রাখা টেবিলের সংলগ্ন ড্রয়ারটি খুলতেই পেয়ে গেলন ডাইরিটা। রমাদেবীর লেখা কিছু মনের কথাগুলি সেই ডাইরিতে শোভা পাচ্ছিল। রমাদেবীর হাতের লেখা আজও ঠিক আগের মতই অসম্ভব সুন্দর ও পরিপাটি। দেখলেই শরীর ও মন পরিতৃপ্ত হয়ে যায়।
ডাইরির দ্বিতীয় পাতায় সুস্পষ্ট অক্ষরে লেখা ছিল কিছু কথা…
‘ এই যে বুড়ো তোমায় ভালোবাসি ঠিকই কিন্তু আমার প্রথম প্রেম কিন্তু অন্য কেউ। কি ?? ঘাবড়ে গেলে নাকি?? আমি ফুচকার কথা বলছিলাম। আমার প্রথম ভালোবাসা। আমার প্রথম প্রেম। এই একটা জিনিস আমার খুব খুব ভালোলাগে। আমি যদি কোনোদিন না থাকি এই পৃথিবীতে এক প্লেট ফুচকা নিয়ে আমায় স্মরণ কোরো। আমি ঠিক চলে আসবো।’
লেখাটা পড়তে পড়তে বিয়ের দিনের কথা মনে পড়ে গেল কুন্তল বাবুর। রমাদেবীর পিতা কুন্তলবাবুকে আলাদাভাবে ডেকে বলেছিলেন ‘ বাবাজীবন। বড় কথা বলছি না মেয়ে আমার সাক্ষাৎ লক্ষী। সমস্ত কাজ ও একা হাতে করতে পারে। এতদিন আমি ওর খেয়াল রেখেছি এখন থেকে ওর সব দায়িত্ব তোমার। আর একটা কথা পারলে ওকে মাঝে মাঝে ফুচকা খাইয়ো। ছোটবেলা থেকে মেয়েটা আমার ফুচকা খেতে খুব ভালোবাসে। যাকে শুদ্ধ বাংলায় বলে নিঃস্বার্থ প্রেম।
কোথায় রমাদেবীর বাপের বাড়ি কলকাতা শহরের মূল প্রান্তে আর কোথায় শ্বশুরবাড়ি বর্ধমান জেলার এক অচেনা গ্রামে!! তখনকার সময়ে এ অঞ্চলে ফুচকা-টুচকা পাওয়াও ছিল বেশ দুরুহ ব্যাপার । সেই শহর থেকে টিফিন বাক্সতে করে সপ্তাহে একদিন ফুচকা নিয়ে আসতেন স্ত্রী এর জন্য। কত মধুরই না ছিল সেসব দিন!! আর এখন তো পাড়ায় পাড়ায় ফুচকা পাওয়া যায়।
তাহলে আর বসে থাকা কেন। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন কুন্তলবাবু।
সন্ধ্যে নেমেছে পরিবেশে। বাড়ির সকলে বেশ চিন্তিত কুন্তলবাবুকে। ওনাকে বাড়িতে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গেলেন। রাগের অভিনয় করলেও দুশ্চিন্তা গ্রাস করেছে রমাদেবীকে। চুপচাপ বসে আসেন টিভির সামনে।
হঠাৎ সদর দরজায় শব্দ হয়। খট খট খট….. বাড়ির সকলে ছুটে আসেন সাথে রমাদেবীও। এ কি কান্ড!! স্ত্রী এর মান ভঞ্জন করতে ফুচকা ওয়ালাকেই নিয়ে চলে এসেছেন বাড়িতে। হাঁপাচ্ছিলেন বয়স্ক কুন্তলবাবু। স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘কই গো গিন্নি। আর রাগ নেই তো আমার উপর।’
রমাদেবী কিছু বলার আগেই চোখ বুজে আসল কুন্তলবাবুর।
কিগো, ওঠো!! আমায় ফুচকা খাওয়াবে না। আমি তোমার রমা। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন কুন্তলবাবু। চারিদিকে প্রায় অন্ধকার। স্যালাইনের নল লাগনো রয়েছে। সামনে বড় একটি মেশিন ক্রমাগত শব্দ করে যাচ্ছে। অন্ধকারে চোখ ধাতস্থ হলে বুঝলেন হসপিটালের বেডে শুয়ে আছেন। সামনের চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আছে একটি নারীদেহ।
দেখে মনে হচ্ছে রমা অর্থাৎ ওনার স্ত্রী। দুবার ডাক দেবার চেষ্টা করলেন। রমা… রমা… গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছে না।
রমাদেবীকে হঠাৎ দেখা গেল বেডের সামনে।
‘একি রমা, তুমি এখানে ??’
‘তোমায় নিতে এলাম।’
‘মানে’
কিছু না, উঠে এসো।’
রমাদেবীর হাত ধরে হসপিটালের বিছানা ছেড়ে উঠে এলেন কুন্তলবাবু। খুব হালকা লাগছে নিজেকে। শরীরে আর কোনো ক্লান্তি নেই। পিছনে হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে একটি দেহ আর একেবারে পাশেই মাথা নুইয়ে থাকা আরেকটি দেহ।
কুন্তলবাবু অবাক দৃষ্টিতে দেহদুটির দিকে তাকিয়ে একটি প্রশ্ন করলেন স্ত্রীকে,
‘এরা কারা??’
রমাদেবী মুচকি হেসে জবাব দিলেন ,
‘আমাদের দুটি দেহ। এই যে বুড়ো, এবার বিশ্বাস হল শুধু ফুচকা নয়, আমি তোমাকেও খুব ভালোবাসি।তোমার জন্য জীবনটাই ছেড়ে দিলাম। নাও এবার তাড়াতাড়ি চল। সবাই এসে পড়বে। দুজনেই হঠাৎ উধাও হয়ে গেলেন। কেবিনের লাইট জ্বললো ডাক্তার এলেন। নিথর দেহদুটি পড়েছিল কিন্তু ততক্ষনে দম্পতি পগার পার।
(সমাপ্ত)