শুভবিবাহ
আজ আবার বাড়ি থেকে বিয়ের কথা বলছে।এই নিয়ে পাঁচবার হতে চলছে।মা বলছে কে একজন এসেছিলো চাকরিওয়ালা ছেলের সন্ধান নিয়ে।
— হুম বিয়ে করে নে।
— কী ধরণের ছোটলোক তুমি?এসব বলতে একটুও আটকায় না মুখে?
— কেন তোর বিয়ের বয়স হয়নি?
— দেখো এইসময় ইয়ার্কি করতে ভালো লাগছে না।
— ইয়ার্কি কোথায় করলাম?বয়স,গতর,ঘুম দিন দিন সবই তো বাড়ছে তোর।এরপর ভালো ছেলেতে আর পছন্দ করবে না।
— ধ্যাৎ!ফোন রাখছি।
— আরে শোন শোন।রাগ করছিস কেন।
— শোনো তুমি কালই আমাদের বাড়িতে এসো।মা,বাবার সাথে কথা বলো।এসে বুঝিয়ে বলো ৬ মাস সরকারি চাকরির চেষ্টার করবে।সরকারি চাকরি নাহলে অন্য কাজ করবে।কজন আর সরকারি চাকরি করে?বাকিদের চলছে কী করে?তারা কি মরে যাচ্ছে?
–ব্যাপারটা তুই মানছিস।তোর মা-বাবা কেন মানবে?সবাই তো নিজের মেয়ের ভালো জায়গাতেই বিয়ে দিতে চাইবে তাই না।তার উপর তুই এত রূপবতী-গুণবতী কন্যে
— মানে তুমিও চাইছো যাতে আমার অন্য জায়গায় বিয়ে হয় তাই তো?
— আচ্ছা বিয়েতে তুই কী রঙের বেনারসি নিবি?নীল কিন্তু একদম নয়।নীল রঙের বেনারসি মোটে ভালো নয়।
— আমার এত কষ্ট হচ্ছে আর তুমি ইয়ার্কি করছো?তুমি জানো ওই সেজেগুজে বলির পাঁঠার মত পাত্রপক্ষের সামনে বসতে কতটা অস্বস্তি লাগে। আসলে তোমার কোনদিন বিয়ে করার ইচ্ছেই থাকেনি।আজ বুঝতে পারছি।
— উফ্!এত দুঃখবাদী কেন তুই? বললি না তো কী রঙের বেনারসি নিবি?
— দড়ি নেবো।গলায় দেওয়ার জন্য শক্ত দড়ি নেবো হয়েছে।
— অবশ্য ভালো দামী বেনারসি নিলেও সমস্যা আছে।তুই আবার………
— আমি কী?
— তুই তো বিয়ের পড়ের দিন সকালে গাড়িতে আমার বাড়ি আসতে আসতে বমি করেই ভাসিয়ে দিবি।ছিঃ ছিঃ এতবড় মেয়ে এখনও বমি করে।লেদুস।
— আমি মোটেও গাড়িতে বমি করি না।আগে হতো এখন হয় না।বমি করি যাই করি তোমার বাড়ি তো আর যাবো না।শ্মশানে যাবো।
— ছিঃ ছিঃ এসব কী কথা।তুই মাথাটা একটু ঠান্ডা কর খেপি।
— তুমি আগে বলো কাল আমার বাড়ি আসবে।আমার আর লুকোচুরি ভালো লাগছে না।
— তোর বাবা আমার হাড়গোড় ভেঙে এক করে দেবে।
— তুমি আসবে? হ্যাঁ কী না বলো।
— আচ্ছা ছেলেপক্ষের কবে দেখতে আসার কথা?
— রবিবার।
— শোন রবিবার তোর জন্মদিনে আমার দেওয়া চুড়িদারটা পরবি।ওই চুড়িদারটায় তোকে লক্ষ্মী প্রতিমার মতো লাগে। চোখে সুন্দর করে কাজল,ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক,কপালে ছোট্ট একটা টিপ আর চুলটা খুলে রাখবি।ওক্কে?
— আমার আর কিছুই বলার নেই।তোমার মধ্যে এতটুকু সিরিয়াসনেস নেই।আমি কাকে নিয়ে এতকাল স্বপ্ন দেখেছি ভেবেই অবাক লাগছে।কান্না পাচ্ছে,নিজের উপর নিজের রাগ হচ্ছে।
— আজব মেয়েতো তুই।আমি তোকে দেখতে যাবো আর তুই সাজবি না?
— মানে?
— মানে আজ বিকেলে তোর বাড়িতে কে গিয়েছিলো খেপি?
— কী বলছো কিছুই বুঝছি না।আমি তো জেঠুর বাড়ি গিয়েছিলাম।একটু আগে ফিরেছি।ফিরেই এসব শুনলাম।জানি না কে।
— ওহে সুদীপা সরকার আজ তোমার বাড়ি আমি গিয়েছিলাম।নিজের জিনিসটা আইনত নিজের করার জন্য।
— সত্যি! কই মা কিছু বললো না তো।মা তো চেনে তোমায়। বাবা তোমায় কিছু বলেনি তো?একবার বললে না আমায় তুমি আসবে।কী বাজে ছেলে তুমি।
— ধূর কে কী বলবে। তুই বেকার ওনাদের ভিলেন বানাতিস।তোর মা তো মাদার ইন্ডিয়া,তোর বাবাও খুব ভালো মানুষ।প্রথম ভ্রূ কুঁচকে ছিলো একটু পরেই সব শুনে খুব খুশি।ওরা বললো তোর ইচ্ছেটাই ওদের কাছে শেষ কথা।আসলে জানিস কেউ নিজে না চাইলে জোর করে বিয়ে দেওয়া যায় না।তোর মা তো দেখছি আমার কথাটাও রেখেছে।তোকে কিছু বলেনি। মাদার-ইন-ল র জন্য লাভ ইউ রইলো।
— মেনে নিলো?তুমি তো চাকরি করো না।
— কে বলেছে করি না?বলেছিলাম না আজ একটা ইন্টারভিউ ছিলো।তোর রাহুল সিলেক্টেড রে খেপি।হ্যাঁ,সরকারি চাকরি নয় তবে তোকে খুশি রাখার জন্য যথেষ্ট।চাকরিটা হয়েছে শুনে প্রথমে মা কে ফোন করেছি তারপর সোজা তোর বাড়ি।তোর এইসব দেখাশোনার ব্যাপার তোর চেয়ে বেশি খারাপ আমার লাগতো।তাই চলেই গেলাম।আমি সবটা বলতে তোর মা-বাবার বক্তব্য তুই রাজি হলে ওদের সমস্যা নেই।তুই তো ভীতু তুই আগে বাড়িতে বললে ওরা দেখাশোনা করাতো না বললো।জানিস তোর মা-বাবা তোরই মতো,খুব ভালো।লাভ ইউ সো মাচ খেপু।
— থাক ঢং করতে হয় না।তোমার সাথে কথাই বলবো না।শয়তান তোমরা দল করে আমাকে বোকা বানিয়েছ।আর একটাও কথা বলবো না যাও।
— ওরে আমার খেপি রাগ করতে নেই।তোর মা কে ঝটপট তোর ইচ্ছেটা বলে দে। আমি-মা-বাবা রবিবার তোর বাড়ি যাচ্ছি।আর তোর মায়ের কাছে তোর জন্য একটা বিরিয়ানি দিয়ে এসেছি।এখনও রাগ ভাঙবে না?
— লাভ ইউ রাহুল,লাভ ইউ সো মাচ।
এক্স_ইকুয়াল্টু_প্রেম
আজ সকাল থেকে সৈকতের ব্যস্ততা তুঙ্গে | আর হবে নাই বা কেন? একমাত্র আদরের বোনের বিয়ে যে | সব দায়িত্ব সৈকতের কাঁধে | বিয়ের সব আচার অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে অতিথিদের আদর আপ্যায়নের দিকে সজাগ দৃষ্টি সৈকতের |
এত ব্যস্ততার মাঝেও ছেলের বাড়ির একজনকে দেখে সৈকতের স্মৃতি ওকে ১০ বছর আগে ফিরিয়ে নিয়ে গেল | কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে হলদিয়াতে পড়তে গেল সৈকত | প্রথমদিন সিনিয়রদের র্যাগিং খেয়ে দিনটা শুরু | হঠাৎ সাদামাটা চেহারার ছিপছিপে রোগা একটা মেয়েকে র্যাগিং খেতে দেখে খারাপ লাগলো সৈকতের | এগিয়ে গিয়ে প্রতিবাদ করে কিল চড় খেয়েছিল বেশ | লজ্জায় অপমানে চোখ মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল সেদিন | নিজের মনে মনে বলেছিল সেদিন ‘কি অকৃতজ্ঞ মেয়ে রে বাবা! একটা ধন্যবাদ না বলে চলে গেল’ |
‘ও দাদা, মেয়ের আর ছেলের নামের বানানটা ঠিক আছে তো? সাজানো কেমন হয়েছে বলুন?’ – গেট সাজানোর লোকের ডাকে চমক ভাঙ্গে সৈকতের | সবার প্রেমের সূত্রপাত হয়তো রাজ সিমরানের মত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে হয় না | ওইদিন ওই মেয়েটাকে বাঁচাতে গিয়ে আগ বাড়িয়ে ক্ষুদিরাম হয়ে আরেকটু হলে সিনিয়রেরা কেলিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দিত | ক্লাসের শেষে করিডোরে দাঁড়িয়ে অনেক ভাবনার আনাগোনার ভিড়ে ছেদ পড়লো একটি মিষ্টি কণ্ঠে ‘ওইদিন তুমি না বাঁচালে কি যে হত | আসলে খুব ভয় পেয়েছিলাম তাই আর ধন্যবাদ বলে ওঠা হয়নি | মফস্বল থেকে পড়তে এসে এমন অভিজ্ঞতা প্রথম’ | মনের মধ্যে এতক্ষণ যে ৪৪০ ভোল্টের বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছিল একনিমেষেই তা যেন উধাও | সেই শুরু মধুপর্ণার সাথে বন্ধুত্ব | মেয়েটা যেমনি পড়াশোনাতে তুখোড় তেমনই নাচে গানে আবৃত্তিতে পটু | মধুপর্ণার মত প্রাণোচ্ছল একটা মেয়ের প্রেমে পড়তে খুব একটা সময় লাগেনি সৈকতের |
‘লাইটিং ঠিক আছে তো দাদা? আর ক্যাটারার প্রথমে চিকেন পকোড়া আর পনির পকোড়া সার্ভ করে দেবে’ – আবার ভাবনাতে ছেদ পড়লো | সামান্য হেসে ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানালো সৈকত | মধুপর্ণার সাথে একসাথে পথ চলার অঙ্গীকার করেছিল সৈকত | কলেজের চার বছরে যেখানে অনেকের ব্রেক আপ হয়েছিল,সেখানে ওদের সম্পর্ক অটুট ছিল | অনেকেই বক্র দৃষ্টিতে ওদের দেখে ঈর্ষান্বিত হত | কলেজের বাইরে কৃষ্ণচূড়া গাছটা ছিল ওদের ভালোবাসার প্রত্যক্ষ সাক্ষী | দুজনের মধ্যে ভালোবাসার বিনিময়ে শারীরিক চাহিদা ছিল না,ছিল না কোনও অহেতুক ন্যাকামি কিংবা কৃত্রিমতার দেখনদারি | শুধু ছিল বৃষ্টিতে ভিজে হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো করতে করতে দু হাত ধরে চলা,আলুকাবলি কিংবা ফুচকা খাওয়ার মাঝে দুষ্টুমিষ্টি দৃষ্টি বিনিময় কিংবা অভিমান করে বাড়ি ফিরে মানভঞ্জনের একটা ফোনের জন্যে বিনিদ্র প্রতীক্ষা |
কলেজের পরে ক্যাম্পাসিং এ টিসিএসে পেয়ে যায় মধুপর্ণা | সৈকতের ভাগ্যে শিঁকে ছেড়ে না | ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে মানসিক দূরত্ব | একটা বেকার ছেলেকে নিজের বয়ফ্রেন্ড হিসেবে পরিচয় দিতে আত্মসম্মানে লাগে বড্ড | ব্যাঙ্গালোরে চলে আসে মধুপর্ণা | আত্মাভিমানের প্রাচীরে ছেদ পড়ে দুজনের সম্পর্কে | সৈকতের ভবিষ্যৎ তখন প্রায়ান্ধাকারে নিমজ্জিত | নিকোটিনের ধোঁয়াতে বুকের যন্ত্রণা গোপন করার মিথ্যে প্রচেষ্টা অব্যাহত |
‘ কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় বসে তোমার চোখে আমার মরণ
নিকোটিনের শেষ ধোঁয়াতে ভালোবাসার রক্তক্ষরণ’ – চোখের জলটা ফোনের স্ক্রিনে পড়ে ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল লেখাটা | নিজের প্রিয়জনের কাছে প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তখন আর স্পেস থাকে না,অব্যক্ত কথাগুলো ব্যাকস্পেসের সাহায্য চাই | মধুপর্ণার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল টিসিএসের কোনও এক সিনিয়র ম্যানেজারের সাথে | যোগাযোগ অনেক আগেই বিচ্ছিন্ন হয়েছিল |
পারস্পরিক সম্মানটুকুকে মর্যাদা দিয়ে আর প্রেমে পড়েনি সৈকত | প্রেমের প্রতি ঘেন্না জন্মে গিয়েছিল | তাই তো অফিসে বহু মেয়ের হার্টথ্রোব ৩২ বছরের সুদর্শন সৈকত মুখার্জী আজও হ্যাপিলি সিঙ্গেল |
মধুপর্ণা চিনতে পারেনি সৈকতকে | বিয়েবাড়ির এত ভিড়ের মাঝে কে কাকে এত ভালো করে খেয়াল করে? সৈকতের মনে কোনও অভিমানের পাহাড় জমেনি | শুধু লুকিয়ে রাখা ডায়েরীর পাতাতে ১০ বছর আগের অস্পষ্ট লেখাটা মনে পড়লো ‘ভালোবাসা ভালো থেকো,ভালো রেখো’ |
(সমাপ্ত)