
কুর্তার ছেঁড়া হাতাটা একটু টানার বৃথা চেষ্টা করে বহ্নি। মিঃ কিশোরীর লোলুপ দৃষ্টিতে ওর চৈতন্য ফেরে খেয়াল করে ওর ব্রায়ের স্ট্র্যাপটা কখন যে উঁকিঝুঁকি করছে অবলীলায় ছেঁড়া হাতার ফাঁক দিয়ে। রোহনের পছন্দে হয়ত একটু বেশিই শৌখিন নিজের পোশাক আর অন্তর্বাসের ব্যাপারে বহ্নি। তবে আজকের ভোরটা কেমন যেন বড় এলোমেলো হয়ে গেছে একটা ঝোড়ো হাওয়ায়,জানেনা ও নিজেও জানেনা এই ঝড়ের কি নাম? কোনদিন কি শান্ত হবে এই ঝড়?
ওর আপাদমস্তক খেয়াল করছেন মিঃ কিশোরী,বহ্নি তখন বসে ওর ঠিকানা অন্নপূর্ণা আ্যপার্টমেন্টের ছয় তলাতে। লিফ্ট তো চলছে মনে হচ্ছে,তবুও উনি হঠাৎ সিঁড়ি দিয়ে নামছেন কেন? মুখটা অন্য দিকে ফেরায় বহ্নি,তবুও কেন যেন বুঝতে পারে একজোড়া চোখ সামনে পেছনে ওকে মাপছে গভীর সন্দেহে,হয়ত বা লালসায়।
প্রায় আধঘন্টা ধরে বেল বাজিয়ে চলেছে বহ্নি,কেউ খোলেনি। রোহনের সাথে ঘন্টা দুয়েক আগে একবার কথা হয়েছিলো তারপর থেকে ওর ফোনটা বন্ধ।
পেছন ঘুরে দশ মিনিটের মধ্যে টের পায়,আরো কিছু পায়ের শব্দ। আজ বোধহয় সবাই মনের সুখে সিঁড়ি বেয়েই নামা ওঠা করছে শুধুই ওকে দেখার জন্য।
“আরে ব্যাপারটা কি বলুন তো?”
“আরে মশায়,ঘরের বৌকে যত বাইরের দুনিয়াতে বের করবেন ততই মুশিবত আছে। ঘর গৃহস্থী করো,ঘরে থাকো,বাচ্চা সামলাও। আমরা আছি কি করতে?”
” যা বলেছেন..নারী স্বাধীনতার পোকা ঢুকেছে না সব মাথায়। আজকাল আর ঘরে মন টেকেনা মেয়েদের। নে এবার বিপদ কেমন বোঝ ঠ্যালা। এসেছে একদম মুখ পুড়িয়ে।”
সকালে লেকের ধারে মর্ণিং ওয়াকের আসরটা একদম জমে উঠলো সবার আলোচনায়। পেপারে চোখ রাখলো চরম উত্তেজনাতে সবাই যদি কিছু খবর জানা যায়।
” আরে হামি তো সবচেয়ে আগে দেখলাম,একদম টুটাফুটা সালোয়ার আরো সব অনেক কিছু পুরো ফিল্মে রেপড আওরতকা মাফিক। শরমে আর দেখতে পারলামনা হায় হায়।”
মিঃ কিশোরী একটু বেশিই দেখে ফেলেছেন,ইশ্ যা অন্যদের দেখা হলোনা এই ভেবে অনেকেই একটু কষ্ট পেলেন।
বেল বাজিয়ে ক্লান্ত হয়ে বহ্নি এবার দিশাহারা হয়ে দরজায় একটার পর একটা দুমদাম ধাক্কা দিতে থাকে। ফ্ল্যাটের একটা চাবি তো ওর কাছে থাকে, ও ঢুকতেই পারতো। কিন্তু দরজা ভেতর থেকে লক করা।
ধাক্কার আওয়াজে ওপরের সিঁড়িতে উঁকিঝুঁকি মারে আরো অনেকে। দরজাটা একটু ফাঁক হয় হঠাৎই।
চিৎকার করে ওঠে বহ্নি,” কি করেছি আমি যে আমি আমার বাড়িতে ঢুকতে পারবোনা। আমি খুব টায়ার্ড রোহন। অন্ততঃ আমাকে চেঞ্জ করতে দাও রোহন,আমার ভীষণ ফ্লো হচ্ছে আমি পারছিনা।”
হঠাৎই বহ্নির দিকে চোখ চলে যায় আরো বেশি করে রোহনের।
তারই মাঝে ওপরের দিকে চোখ চলে যায় রোহনের,অনেকগুলো চোখ দেখছে। বহ্নি ঢুকতে যায় জোর করে,রোহনের দুই চোখ ওকে পরীক্ষা করছে,মাপছে বুঝতে পারে। হয়ত খুঁজছে রক্তের দাগও। রোহনের দুচোখে আজ শুধুই ঘৃণা তাই ছিঃ বলে বহ্নিকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।
রক্তের রঙ আর ভালোবাসার রঙ নাকি লাল হয়। তবে আজ বহ্নির মনে হলো সবটাই বোধহয় চোখের মণির কালোতে চাপা পড়ে গেছে। অথচ এই রক্ত দেখে কি খুশিই হয়েছিলো একসময় রোহন,এখনো তা ভুলতে পারেনি বহ্নি। চিরকালই ডানপিটে,খোলামেলা আর বন্ধুদের খুব প্রিয় বহ্নি।মানে একদম টমবয় ছিলো কলেজে। মাসতুতো বোনের বান্ধবীকে দেখেই ভালো লেগে গিয়েছিলো রোহনের ও তখন সবেই চাকরির দুবছর পার করে একবছরের জন্য নিউজার্সিতে।
মাসতুতো বোনকে মজা করে বলেছিলো,” আমি বললাম, আর তুইও ঘটকালি শুরু করলি। কি রে তোর বন্ধুর লাভ টাভ নেই তো?”
” থাকলেই বা কি দাদাভাই, তুমিও তো কলেজে একটু আধটু ইয়ে টিয়ে মানে…”
বলেই হেসে অস্থির। কথা হয়েছিলো রোহন বিদেশ থেকে ফিরলেই বিয়ে ততদিনে বহ্নির পড়াশোনাও মোটামুটি শেষ হয়ে যাবে।
মেসেজে,আরে মেলে প্রেমে মাখা বছর কাটিয়ে রোহনের হৃদয়বন্দী হয়েছিলো বহ্নি যদিদং হৃদয়ং করে। বিয়ের আগেই হানিমুনের ব্যবস্থা একদম পাকা ছিলো তাই কাছে পাওয়ার অপেক্ষার অবসান হয়েছিলো একদম শরীরের আর মনের কাছাকাছি হয়ে একান্ত নিভৃতে দুজনের। কিছুটা অনভিজ্ঞতা,কিছুটা প্রথম আবেদনে সিক্ত হয়ে দুজনেই যখন অস্থির তখন রক্তের লাল রঙটা দেখে বেশ ভালো লেগেছিলো রোহনের কি যেন একটা কথা শুনেছিলো সতীচ্ছেদ বা সেই রকম কিছু। ইশ্ বহ্নির বোধহয় সেরকমই কিছু একটা হয়েছে এটা পিরিয়ড নয়। প্রথম সতীত্বের পরীক্ষা না জেনেই দিয়ে ফেলেছিলো বহ্নি,নিজের পৌরুষের পরিতৃপ্তিতে খুশি হয়েছিলো রোহন। যাক সবটা তাহলে ঠিকঠাক আছে।
তবে কেন আজ রক্তের কথা শুনে গা টা গুলিয়ে উঠলো। অনেকবার বারণ করেছে,” শোনো আগে যা করেছো করেছো দেখতে দেখতে বিয়ের বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেছে। আমাদের ঘরেও একটা পুচকে এসেছে এখন ওর প্রায় তিন হয়ে আসছে। এরপর স্কুলে যাবে। তুমি ঐ সব স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজ মানে সমাজসেবা টেবা ছাড়ো। মাঝে তো ছেড়েও দিয়েছিলে।”
” হ্যাঁ ছেড়েছিলাম,বাবাইয়ের জন্য কিছুদিন। কিন্তু ওদেরও আমাকে লাগে রোহন। এই তো সেদিনই দুটো মেয়েকে বাঁচালাম আমরা,রীতিমত শহরের মাঝে ফ্ল্যাটবাড়িতে চুটিয়ে কাজের নামে ওদের দিয়ে ব্যবসা করাচ্ছে। ভাবতে পারো!”
রোহন বাধা দিলেও শোনেনি বহ্নি,প্রায়ই রেডলাইট এরিয়া বা নিষিদ্ধপল্লীর উন্নয়নের কাজ করত কখনো ওদের দল উদ্ধার করত পুলিশের সাহায্য নিয়ে বেশ কিছু কিশোরীকে যাদের পাচার করে দেওয়া হচ্ছে। বেশ কয়েকবার হুমকি আর উড়োফোনও পেয়েছে কিন্তু থামেনি। ভীষণ বিরক্ত হয়েছে রোহন,ঝগড়া হয়েছে কখনো তবুও কাজ বন্ধ করেনি। অসহায় মেয়েগুলোর জন্য ঝুঁকি নিয়েও ছুটে গেছে ছেলেকে মালতীমাসির কাছে রেখে।
সেদিনও দুপুরে তেমনি গিয়েছিলো,রাতে ফেরার কথা ছিলো। কোনদিনই রাতে বাইরে থাকেনা বহ্নি ছেলের আর সংসারের জন্য তবে শুধু সেদিনই ফেরা হয়নি। খবর পেয়েছিলো চোদ্দ বছরের দুই কিশোরীকে দিয়ে ব্যবসা করাচ্ছে ওরা, অসহনীয় জীবন ওদের। ওদের উদ্ধার করতে এসে নিজেরাই বিপদে পড়েছিলো,পুলিশ আসতে যদি আর কিছুটা দেরি করতো…এখনো গা টা শিউরে ওঠে ভয়ে,অনেকগুলো গুন্ডার মত বিশালদেহী লোক,ওদের দলের ছেলেদের প্রচন্ড মারছিলো ওদেরকে টানতে টানতে নিয়ে জামার অনেকটা ছিঁড়ে দিয়ে বুকটা হাত দিয়ে চেপে ধরেছিলো..” টিকটিকির মতো টিকটিক করা,আমাদের ব্যবসা বন্ধ করবি? তোদেরই বেচে দেবো রেপ করে শালী। আর মুখ দেখাতে পারবিনা সমাজে। দেখি কে তোদের সমাজে নেয়?”
চূড়ান্ত হেনস্থা হয়ত ঠেকানো যেতনা যদি পুলিশ না এসে পড়ত। লোকগুলো তখনো রাগে ফুঁসছিলো। পরে পুলিশরা ওদের সাবধান করেছিলো,” ম্যাডাম খবরটা আমরাও পেয়েছিলাম,রাতেই আসতাম। তার আগেই আপনারা এভাবে।খুব বড় রিস্ক নিয়েছেন আপনারা। ভাগ্যিস আমরা এসেছিলাম।”
কৃতীত্বটা ওনারাই নিলেন,তখনো ভয়ে আর ঘেন্নায় কেমন যেন বমি পাচ্ছিলো ওর। মেয়েদুটোকে পাঠিয়ে সবটা সামলাতে প্রায় মাঝরাত। ওর ফোনটা প্রথমেই ওরা কেড়ে নিয়েছিলো। বাড়িতে ফোন করে ব্যাপারটা কিছুটা বলতে গিয়েও,রোহনের চিৎকারে থমকে গিয়েছিলো..” এনাফ ইজ এনাফ,প্রায় একশোবার তোমাকে কল করেছি,ছেলেটা খুব কাঁদছিলো রাখা যাচ্ছিলো না। এখন মাঝরাতে তোমার অভিসারের গল্প দিতে এসেছো! আমার তো মনে হয় তোমরাও আছো এই বিজনেসে। আমার একটা পজিশন আছে সোসাইটিতে মাইন্ড দ্যাট। ছিঃ ছিঃ কি হয়েছিলো ডোন্ট এক্সপ্লেইন,আই ওন্ট হিয়ার।”
ফোনটা কেটে দিয়েছিলো আর তারপর সুইচড অফ।
একটু করে নিজের হাতে গোছানো সংসারে আর ঢোকা হয়নি বহ্নির,দরজার বাইরের ওয়েলকাম বোর্ডটা আর তার নিচের স্মাইলিটা দেখে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছিলো ওর। খুঁজে খুঁজে কিনেছিলো এক সময়, আর আজ ওরই অধিকার নেই বাড়িতে ঢোকার।
নিজের পোশাকটা সামলে মাথা উঁচু করে অনেকগুলো জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে রাস্তায় নেমে একটা ট্যাক্সি ধরে বাপের বাড়ি চলে এসেছিলো। খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো ছেলেটাকে একবার,আজও হয়ত কাঁদবে আবার সকালে ঘুম থেকে উঠে। বাপের বাড়িতে থাকার মধ্যে আছে অসুস্থ বাবা মেয়ের হেনস্থায় আরো কষ্ট পেলেন। রোহন ডিভোর্সের চিঠি দিলো,ওর চরিত্রের প্রতি সন্দেহ প্রধান কারণ এবং অনেকবার বলা সত্ত্বেও বহ্নি ধর্ষিতা কিনা সেই পরীক্ষাও সে করেনি সুতরাং এর থেকে ধরা হচ্ছে তার নিজস্ব কোন দোষ আছে বা ছিলো সুতরাং এমন অসতী স্ত্রীর সাথে বাস করা চলেনা এমনকি ছেলেকেও সে ছাড়বেনা চরিত্রহীন,দায়িত্বহীন মায়ের কাছে।
বহ্নি শুধু বলেছিলো,” আমি এই যুগের মেয়ে সীতা নই যে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য বারবার অগ্নিপরীক্ষা দেবো। আমার,পুলিশের এদের কথাই কি যথেষ্ট নয়। আর সন্দেহে ভরা সম্পর্কে এমনিতেই চিড় ধরেছে আমি বারবার পরীক্ষা করালেও সেটা যাবেনা। তখন কথা হবে ওরা আমাকে ছুঁয়েছিলো,জামা ছিঁড়েছিলো।”
ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিলো ওদের। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান,শুধু ছেলেটার জন্য খুব মন খারাপ করেছিলো। ছেলেটাকে দিতে চায়নি ওরা,বলেছিলো ও নাকি অযোগ্য ছেলের দায়িত্ব নেবার জন্য। এমনিতেই সময় দিতোনা ছেলেকে। মেনে নিয়েছে বহ্নি তবুও কিছু বলেনি নিজেকে বেশি ব্যস্ত করে রেখেছিলো কাজে। কারণ হয়ত বুঝেছিলো ও কাজ ছাড়তে পারবেনা,এক সময় হয়ত ছেলেও ওকে ঘেন্না করবে বাবার মতই। কিছুদিন বাদে ও শুনেছিলো রোহন আমেরিকা চলে যাচ্ছে আবার। পাগলের মত ছুটে যেতে ইচ্ছে হয়েছিলো ছেলেটার জন্য। তারপর হঠাৎই মনে হয়েছিলো,থাক অযথা মায়া বাড়িয়ে কি লাভ?”
তারপর আর কোন যোগাযোগ হয়নি,রোহন আর বহ্নির সম্পর্কটা হারিয়ে যাওয়া বইয়ের কয়েকটা ছেঁড়া পাতার মতই মনের কোণে রয়ে গিয়েছিলো।
মাঝে কেটে গেছে পঁচিশ বছর,অনেকদিন আগের আঠাশের বহ্নির এখন তিপ্পান্ন। কানের দুপাশের রূপোলি রেখা জানান দেয় বয়েস হচ্ছে,বসন্তের বিদায়ের ঘন্টা বাজছে। বাবা চলে গেছেন অনেক দিন। এখন ও নিজেই নিজের অভিভাবিকা। তবে বহ্নিকে এখন এক ডাকে অনেকেই চেনে। কখনো ওদের কাজকর্মের কথা প্রকাশিত হয় সংবাদমাধ্যমে বা দূরদর্শনে।বিদেশ থেকেও অনেকে আসেন,সাহায্যও পায়। বহ্নির জন্য অনেকেই দেখেছে আলো,পেয়েছে ঘর,ফিরে এসেছে সুস্থ সমাজে। অন্ধকার থেকে আলোতে ফেরানোর সংস্থা ওদের তাই নামটাও ‘আলো’।
নিজের জীবনের সাথে নতুন করে আর কাউকে জড়ায়নি বহ্নি, বেঁচেছে নিজের মত করে। বারবার পরীক্ষা দিতে একদম নারাজ ও তাই আত্মসম্মানকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। সংসারে অবিশ্বাসের বেড়াটা যখন একলাফে ডিঙিয়ে এসেছিলো সেদিনই ভাবেনি তখন আর ভাবতে চায়না। শুধু আজও মনে হয় ছেলেটার কথা,কে জানে কোথায় আছে?রোহন বিয়ে করেছিলো শুনেছে,নতুন মায়ের কাছে পুচকেটা কেমন আছে কে জানে? পুচকে কথাটা মনে করতে হাসি লাগে। পুচকে কোথায়! ছেলেও তো অনেকটা বড় হয়েছে,হয়ত বিয়েও করেছে পছন্দের কাউকে। রোহন হয়ত বলেইনি ওকে ওর মায়ের কথা,হয়ত বাবার মতই ও মাকে অসতী আর স্বার্থপর ভাবে আর ঘেন্না করে।
” দিদিমণি,বাইরের ঘরে তোমাকে ডাকছে মেঘনা দিদিমণি আরও দুজন এসেছে।”..পরীর ডাকে চিন্তায় ছেদ পড়ে। পরীকে উদ্ধার করেছিলো পাঁচ বছর আগে বাড়ীর লোক নেয়নি। তারপর থেকে রয়ে গেছে ওরই কাছে।
শাড়িটা ঠিক করে সামনের ঘরে আসে বহ্নি। ” দিদি,এরা তোমার সাথে দেখা করতে চায়,ও সেলিনা আর ও মিলি।ওরা একটা বই প্রকাশের অনুষ্ঠানে তোমাকে আমন্ত্রণ জানাতে চায়।” মেঘনা ওদের সংস্থারই মেয়ে ও আলাপ করিয়ে দেয় ওদের বহ্নির সাথে। ভালো লাগছে কেউ এমন একটা বিষয়ের ওপর বই লিখছে,অন্ধকারে ঢাকা মেয়েদের জীবন নিয়ে বই।
আলাপের মধ্যেই কফি দেয় পরী,এমন অনেকেই মাঝে মাঝে আসে ওর কাছে। আজকাল যেতেও হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। অনেক সময়ই সম্মানিত হয়। ওদেরও কথা দেয় যাবে বলে।
“পরী আমার শাড়িটা একটু ঠিক করে দে না। মাঝে মাঝেই হাঁটু ভোগাচ্ছে। তাই ঝুঁকে কাজ করতে অসুবিধেই হয়।”
“এত কাজ করলে হবেনা!একটু বিশ্রাম নাও এবার।অনেক তো হলো। কদিন একটু বাইরে ঘুরে এসো।”
দীর্ঘশ্বাস পড়ে বহ্নির কতদিন কোথাও যায়নি,আর কার সাথেই বা যাবে? অথচ একটা সময় বছরে দুবার না বাইরে গেলে ওর ভালোই লাগতোনা। ” হ্যাঁ রে যাবো,কদিন ভাবছি শান্তিনিকেতনেই যাবো।তুই যাবি তো আমার সাথে?”
শাড়ির কুচি ঠিক করতে করতে হাসে পরী,” আমাকে ছাড়া তোমার চলবে?”
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে বহ্নি,পরনে টেম্পল পাড় তসর।হাতে আর কানে ডোকরার গয়না,গলায় গণেশের লকেট। পরী হাতে করে আনে বাগান থেকে একগোছা গেরুয়া রঙের বোগেনভেলিয়া,খোঁপায় গুজে দেয়। ” আরে করলি কি!আমাকে যে একদম সন্ন্যাসীনী বানিয়ে দিলি। ” তুমি তো তাই দিদি,তোমার মত এত ভালো কজন আছে?আজকাল সন্ন্যাসীদের যা সব শুনি…” পরীর কথা শুনে হাসে বহ্নি,”থাক আর বলিসনা।”। ততক্ষণে গাড়ি এসে গেছে তাই হাতে ব্যাগ নিয়ে নিচে নামে বহ্নি।
বেশ বড় আয়োজন, বেশ কয়েকজন পরিচিত মানুষজনকে দেখলো। সাদরে এনে বহ্নিকে বসানো হলো একদম সামনের সারিতে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সম্মানিত করা হলো ওদের কয়েকজনকে। তারপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর বই প্রকাশের অনুষ্ঠান।
বইটা ইংরেজীতে লেখা বই সম্বন্ধে বলছে লেখক,অবাক লাগে বহ্নির ছেলেটার কথাগুলো শুনে। কত আর বয়েস হবে,তবুও কি সুন্দর মার্জিত আর উদার ভাবনা।সত্যি আজকাল নতুন প্রজন্মের ধ্যান ধারণাও কত উন্নত। হয়ত এইভাবে এগিয়ে যাবে সমাজ এদের হাত ধরে।
শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল বহ্নি,অথচ একটা সময় এই অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের উদ্ধার করতে গিয়ে ওর সবটাই এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো।
” আমার বইটা আমি উৎসর্গ করেছি আমার সবচেয়ে কাছের একজনকে যিনি আজ এখানে উপস্থিত। আমি যাকে দিতে চাই বইটা তিনি আমার মা, যিনি একসময়ে অসতী আর খারাপ চরিত্রের বদনাম নিয়ে ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন নিজের সংসার এবং সন্তানকে। আর তারপর থেকে তার ছায়াও পড়েনি আমার ওপর। আজ খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছে তাকে।”
চোখদুটো জলে ভাসছে বহ্নির,ওর পুচকেটা এতো বড় হয়ে গেছে! বই লিখেছে! ও কেমন মা যে ছেলেকে দেখেও চিনতে পারেনি? অথচ ছেলেটা কোথা থেকে এতটা শ্রদ্ধার ডালি উজাড় করে দিলো ওকে!মিষ্টি হেসে সেলিনা বলে,”অনেক খুঁজেছে বড় হবার পর আপনাকে,বাবার সাথেও এই নিয়ে অশান্তি হয়েছে।সব সময় বলতো আমার মাকে চাই।তারপর একটা সময় আলাদা হয়ে গিয়েছিলো একদম একা হয়ে গিয়েছিলো। তখন আমরা সবাই মিলে খুঁজেছি আপনাকে। আসুন ও ডাকছে অপেক্ষা করছে।” হাত ধরে বহ্নিকে নিয়ে যায় একদম অমিতাভ মানে বহ্নির ছোট্ট বাবানের সামনে।
বহ্নির হাতে বইটা দিয়েছে ছেলে,চোখটা খুব ঝাপসা তখন,ছেলেটা যে সেই ছোটবেলার মত আঁকড়ে ধরেছে ওকে।যেন বলছে এতক্ষণ কোথায় ছিলে আর ছাড়বোনা তোমায়। আজ পরম নির্ভরতায় ওর চওড়া কাঁধে মাথা রেখেছে বহ্নি। হল জুড়ে তখন শুধুই হাততালি আর তার মাঝেই হারিয়ে যাওয়া মা আর ছেলের সেই ছোট্টবেলার মত। অনেক চেষ্টা করেও রোহন পারেনি বহ্নির থেকে ওর পুচকেটাকে আলাদা করতে। রক্তের টানে মিলে গেছে দেশে থাকা বহ্নি বিদেশে থাকা সন্তানের সাথে প্রায় পঁচিশ বছর পর।
আরে বইয়ের লেখাটা তো চোখের জলে চোখেই পড়েনি…’আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’..মাই মম ‘বহ্নি’ ক্যান টাচ্ ডার্কনেস উইদাউট ফিয়ার।
সমাপ্ত:-