চিনি কম
________
“রমা চা হলো ? ব্ল্যাক টি উইদাউট সুগার। আমি লাইব্রেরী রুমে আছি দিয়ে যাও।”
“হ্যাঁ আনছি”.. রমা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে জবাব দিল।
কাপে চা ঢালতে ঢালতে রমা ভাবতে লাগলো এই লিকার চায়ের মত তার দাম্পত্য জীবনের মিষ্টতাও যেন কমে আসছে।
আজ ওদের ২৫ তম বিবাহ বার্ষিকী.. অথচ অশোকের মনেই নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চা’টা নিয়ে রমা লাইব্রেরী ঘরে এল।
অশোক কলেজের ইকোনমিক্সের অধ্যাপক। খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা পড়ছিল। রমাকে দেখে বলল, কাল কলকাতায় একটা সেমিনার আছে। সকাল সকাল উঠতে হবে। তুমি তাড়াতাড়ি ডিনারটা দিয়ে দিও। বেশি কিছু দিও না। গ্যাস অম্বল হয়ে যায়। দুটো রুটি আর একটু চিকেন স্টু।
রমা বলল, –চলোনা , আজ আমরা ডিনারটা কোথাও বাইরে গিয়ে করি। অনেকদিন তো বেরোনোই হয়না।
অশোক চশমার কাচটা রুমালে মুছতে মুছতে বললো ,”কতগুলো বাজে পয়সা খরচ করে সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করে কি লাভ, তার থেকে ঘরেই ডাল ভাত খাও… শরীর ভালো থাকবে। নীল এম.বি.এ. করতে হায়দ্রাবাদ গেল। জানোইতো এম.বি.এ. পড়ার কতো খরচ! এখন পাই পয়সা জমা করতে হবে ছেলের জন্য। তুমিও এবার থেকে একটু বুঝেশুনে খরচা করো।
যথারীতি এই বছরও আজকের দিনটা অশোকের মনে নেই বুঝলো রমা। মনে করানোর চেষ্টাও করল না। রান্নাঘরে এসে রান্নাতে মন দিল।
সন্ধ্যে থেকে রোজকার মত বেশ কয়েকটা চ্যানেলের খবর শুনল অশোক। জামাকাপড় প্রেস করল কালকে পরে যাবে বলে। দুজনের ডিনারের ফাঁকে ফাঁকে রাজনীতির কথা, ছেলের কথা , টুকটাক হতে থাকলো। দশটার মধ্যে অশোক শুয়ে পড়ল।
রমা আজ পুরনো অ্যালবামগুলো নিয়ে বসলো। ছবিগুলো দেখতে দেখতে কত টুকরো টুকরো কথা মনে পড়ছে। বিয়ের পরের বছরগুলো প্রতিটা দিন ছিল মাধুর্যে , রোমান্টিকতায় ও মিষ্টতায় ভরপুর।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল রমার। নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের চার বোনের সবথেকে বড় বোন ছিল রমা। এক ঢাল কোচকানো চুল, টানা টানা কৌতুক ভরা চোখ, খুব মিষ্টি মুখ, হাসলেই গালে টোল পড়ে, ছিপছিপে চেহারার রমাকে দেখে পছন্দ হয়ে গেছিল অশোকের। বাবা-মা সুপাত্র পাওয়ায় চার হাত এক করতে দেরি করেনি। বিয়ের পরের দিনগুলো ছিল স্বপ্নের মত। তখন ল্যান্ডলাইন ছিল। কলেজ থেকে যে কতবার ফোন করতো অশোক।
অ্যালবামে একটা ফটো দেখে হেসে উঠল রমা। প্রচন্ড ভয়ে রমা চিৎকার করে লাফাচ্ছে। মনে পড়ে গেল ঘটনাটা। সেদিনটাও ছিল বিবাহ বার্ষিকী। সেদিন অশোক কলেজ থেকে ফিরে ক্যামেরাটা আলমারি থেকে বের করে টেবিলের উপর রাখল। তারপর রমাকে রান্না ঘরে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ এনে বলল, শুভ বিবাহ বার্ষিকী ডার্লিং.. আজ তোমার জন্য একটা গিফট এনেছি। খুব সুন্দর মুক্তোর কানের দুল…
রমা সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে , ওমা কই দেখাও দেখাও। চোখেমুখে খুশীর আলো।
অশোক পকেট থেকে সুন্দর কাগজে প্যাক করা , রিবন দিয়ে বাঁধা কৌটোটা রমার হাতে দিল। রমার তর সইছে না।তাড়াতাড়ি কাগজের প্যাকিংটা খুলতে লাগল।অশোকের চোখে দুষ্টু হাসি। রমা কৌটোটা খুলতেই তিন চারটে আরশোলা কৌটো থেকে বেরিয়ে রমার গায়ে এসে পড়ল। আর রমার কী চিৎকার.. ভয়ে তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে শুরু করেছে ।অশোক তখন হাসতে হাসতে ক্যামেরায় ক্লিক করে মুহূর্ত টাকে ফ্রেম বন্দি করে। অশোক জানতো রমার আরশোলাতে খুব ভয়। রমা ততক্ষনে অশোকের পিঠে গুম গুম করে কিল মারছে ,
–তুমি খুব বাজে, বদমাইশ..
অনেক কষ্টে রমাকে শান্ত করে ওর জন্য আনা পার্লস সেটটা ওকে গিফ্ট করেছিল। আদরে আদরে সেদিন রমাকে পাগল করে তুলেছিল অশোক।
ঢং ঢং করে দেয়াল ঘড়িটা বারোটা বাজার জানান দিল। রমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অ্যালবামটা আলমারিতে তুলে রেখে শুতে এসে দেখল অশোক অঘোরে ঘুমাচ্ছে। অথচ আজকের দিনে কি পাগলামিটাই না করত। গুচ্ছ গুচ্ছ গোলাপ বুকেতে ঘর সাজাতো। নিজে হাতে রান্না করতো। নিজের পছন্দের শাড়ি কিনে এনে রমাকে পরতে বলতো। ঘরের লাইট গুলো নিভিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে ডিনার হত। সে এক অন্য রকম পরিবেশ।
সকালে উঠে অশোক বলল,
ওর আজকে খিদে নেই , সেমিনারে লাঞ্চের ব্যবস্থা থাকবে ,ওখানেই খেয়ে নেবে। শুধু চা বিস্কুট খেয়েই বেরিয়ে যাবে।
চিনি ছাড়া এক কাপ চা আর বিস্কুট খেয়ে রেডি হয়ে নিল অশোক। রমা একটু চিঁড়ের পোলাও টিফিনে বানিয়ে দিল। যাবার আগে অশোক বলে গেল রমা যেন প্রেসারের ওষুধটা সময় মত খেয়ে নেয়। না হলে আবার কিছু হলে ওকেই ভুগতে হবে তাও শুনিয়ে গেল।
একটু পরেই নীলের ফোন এলো। সেই একই কতগুলি গতে বাধা কথা বলে গেল নীল.. ওষুধ-পত্র ঠিক করে খেও.. বাবাকে বলবে তোমাদের দুজনের মেডিক্লেমটা করিয়ে নিতে..হঠাৎ যদি তোমাদের কিছু হয় আর তাতেই সব পয়সা বেরিয়ে যায় তাহলে ওর পড়াশোনা মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাবে.. রাত জেগে মোবাইল ঘাটবে না.. চোখ খারাপ হবে… আমাকে যখন তখন ফোন করো না ..কখন কোথায় থাকি.. আমি তোমাদের ফোন করে নেব.. বাবাকে বলবে এই মাসে একটু বেশি টাকা পাঠাতে.. আমাকে কতগুলো বই কিনতে হবে.. ইত্যাদি ইত্যাদি …
রমা ফোনটা রেখে মনে মনে ভাবল, তার ছেলে কি সত্যিই খুব বড় হয়ে গেছে.. বড় হলে কি শৈশবের সব মিষ্টতা গুলো হারিয়ে যায়.. একবারও তো বলল না , মা তোমার হাতে কত দিন চিলি চিকেন খাই নি.. বিরিয়ানি খাইনি.. সিমুই এর পায়েস টা খুব মিস করছি. এগুলোতো মায়ের হাতে ছাড়া ওর ভালোই লাগতো না.. একবারও তো বলল না , মা তোমার জন্য খুব মন খারাপ করে মাঝে মাঝে.. মা তুমি বন্ধুদের সাথে গল্প করো মন ভালো থাকবে..বাবাকে নিয়ে মাঝে মাঝে বেড়িয়ে এসো .. সিনেমা দেখে এসো.. মা কতদিন আমার চুলে বিলি কেটে দাও নি.. পিঠে সুড়সুড়ি দিয়ে দাও নি.. ছোটবেলায় যেমন দিতে..
হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি আসায় সম্বিত ফিরল রমার। ছুটে গিয়ে ছাদ থেকে কাপড় গুলো তুলে নিয়ে এলো। জানলা বন্ধ করতে করতে আবার মনে পড়ে গেল কিছু মধুর মুহূর্তের স্মৃতি .. স্মৃতিই তো.. মুহূর্তগুলো তো আর ফিরে আসে না..
এমনই এক বৃষ্টির দিনে কলেজ থেকে ফিরেই অশোক রমাকে টানতে টানতে নিয়ে গেছিল ছাদে, চলো আজ বৃষ্টিতে ভিজবো। কি পাগলটাই না ছিল তখন। যাবার সময় রান্নাঘর থেকে একটা হাঁড়ি নিয়ে গেছিল। রমা ভালো গান গাইত। দুজনে ছাদে বৃষ্টির মধ্যে এসে দাঁড়াল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিজে একসা। রমার চুল দিয়ে জল পড়ছে ,কপাল দিয়ে জল পড়ছে… ভিজে চুল, সিক্ত বসন রমাকে মুগ্ধ চোখে দেখতে দেখতে অশোক আবদার করল একটা গান করার জন্য.. রমা গান ধরল, রিমঝিম ঘিরে শাওন.. সুলাগ সুলাগ যায়ে মন.. অশোক হাঁড়ি বাজাতে লাগল। তারপর কিছুক্ষণ পর ঘরে এসে দুজনেই হ্যাচ্চো হ্যাচ্চো করতে শুরু করলো। সেদিন খিচুড়ি আর ডিমের ওমলেট অশোকই বানিয়েছিল। রাত্রে শোবার সময় রমা সারাদিনের কথা বলতে শুরু যেই করল তখনি অশোক রমার ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে ওকে চুপ করিয়ে কপাল থেকে চুল গুলো সরাতে সরাতে বলতে লাগলো, ‘for god sake hold your tongue and let me love’..
বাইরে তখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি.. আর ভেতরে দুই কপোত-কপোতি একটু একটু করে ভালবাসার বৃষ্টিতে ভিজছে তখন।
আর এখন জানলা খুলে বৃষ্টি দেখলে অশোক বিরক্ত হয়ে বলে, কী এত বৃষ্টি দেখছো বলোতো.. বৃষ্টি তো আজকের সব কাজকর্মই পন্ড করে দিল.. জানালাটা বন্ধ করো.. ছাঁট এসে ঠান্ডা লাগবে.. তখন তো আমাকেই ভুগতে হবে..
কলিং বেলের আওয়াজে ভাবনায় ছেদ পড়ল। দরজা খুলে দেখল রমার বান্ধবী জয়ন্তী আর ওর বর এসেছে ওদের ২৩তম বিবাহ বার্ষিকীর নেমন্তন্ন করতে। অনেকদিন পর জয়ন্তীকে পেয়ে খুব ভালো লাগছে রমার। জয়ন্তীর একটাই মেয়ে। ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে এইবারই কলেজে ভর্তি হয়েছে। প্লেটে মিষ্টি, নিমকি সাজিয়ে দিল রমা। জয়ন্তী কথায় কথায় বলল, আর বলিস না.. তোর বিজনদা এত ছেলেমানুষ.. বলেছিলাম কোন আয়োজন করার দরকার নেই .মেয়ে বড় হয়ে গেছে..কে কার কথা শোনে..ওর কাছে নাকি সব বিবাহ বার্ষিকীই প্রথম বিবাহ বার্ষিকী..এখনো অবধি যা আদিখ্যেতা করে জানিস না..যখন তখন সারপ্রাইজ গিফট.. হঠাৎ হঠাৎ ওনার ইচ্ছে হয় বউকে নিয়ে লং ড্রাইভে যেতে..বাইরে খেতে ..সিনেমা দেখতে..আমার মেয়ের হিংসে হয় জানিস..বলে বাপি তুমি মামনি কে বেশি ভালোবাসো আমাকে কম।
হাসি হাসি মুখ করে শুনছিল রমা.. মনের ভেতরটায় কেমন যেন একটা চাপ অনুভব করছিল।
মিষ্টি রোমান্টিক দাম্পত্য জীবনের গল্প শুনিয়ে চলে গেল জয়ন্তী। রমা ভাবতে লাগল জয়ন্তীর জীবনে তো টক-ঝাল-মিষ্টি সবটাই এখনো আছে। অথচ রমার দাম্পত্য জীবনে মিষ্টতা কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। একটু বয়স হলে কি ভালোবাসা ক্রমশ হারিয়ে যায়!
দায়িত্ব কর্তব্যের চাপে.. নীলের জন্মের পরে পরিবর্তনটা শুরু হয়েছিল অশোকের। যদিও খুব কম। তখন চোখে পড়ার মত খুব একটা ছিল না ।.. কিন্তু নীল যত বড় হতে লাগল অশোকের পরিবর্তনটা তত স্পষ্ট হতে লাগল.. কেমন যেন বদলে যেতে লাগল অশোক.. সেই পাগলামি, সেই ভালোবাসা , ছেলেমানুষি সব জীবন থেকে যেন একটু একটু করে হারিয়ে যেতে লাগলো.. নিজের ক্যারিয়ার , ছেলের ক্যারিয়ার , পয়সা রোজগার — এগুলো ভালবাসায় ভরা মিষ্টি দাম্পত্য জীবনকে কোথায় যে দূরে ঠেলে দিল..
একটা সময়ে রমার জন্মদিনের দিন অশোক কী করবে ভেবে পেতো না.. ঘুম থেকে উঠেই রমা দেখতে পেত তার বালিশের পাশে বার্থডে কার্ড.. সেখানে অশোকের নিজের হাতে লেখা প্রেমের কবিতা আর একটা লাল টকটকে তরতাজা গোলাপ ফুল ! এরপর সারাদিন আরো কত পাগলামি থাকতো। আর এখন তো স্ত্রীর জন্মদিনটুকু মনেও থাকেনা অশোকের। নীল যদি মনে করিয়ে দেয় তখন অশোক বলে বুড়ো বয়সে আবার জন্মদিন কি.. ওইসব ছাড় তো..
রমা ভাবে এত তেতো কি করে হয়ে গেলে তাদের দাম্পত্য জীবন.. এমন তো ছিল না..
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। রমার একটু চোখ লেগে গিয়েছিল। কলিং বেলের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। দরজা খুলে দেখল অশোক ফিরেছে।
“উফ সারাদিন যা পরিশ্রম গেছে.. জামা কাপড় চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে আসছি। একটু চা বানাও তো.. ব্ল্যাক টি.. চিনি দিও না কিন্তু.. তোমার আবার আজকাল যা ভুলোমন হয়েছে.. যবে থেকে মোবাইল হাতে এসেছে.. ফেসবুক দেখতে দেখতে মাঝে মাঝেই আমার চায়ে চিনি দিয়ে ফেলছো.. জানোই তো আমার সুগার আছে..
তড়িঘড়ি রমা গেল রান্না ঘরে.. ব্ল্যাক টি কাপে ঢালতে ঢালতে রমা ভাবতে লাগল তার দাম্পত্য জীবনটাও ঠিক এই চিনিবিহীন চায়ের মতোই বিস্বাদ হয়ে গেছে.. দুধ চা পাতা হয়তো সবই আছে শুধু চিনি কম।