Bengali Story – Bangla Golpo

বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা‌।বাসে উঠে সীট না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছি।ভীড় আছে মোটামুটি। গাদাগাদি যে ভীড় টা হয় সেটা নেই।সীট না পেলেও ঠিক ঠাক দাঁড়িয়ে থাকা যাবে।আমি দাঁড়িয়ে আছি আর আমার সামনের সীটটায় বসে আছে দুজন মহিলা।একজনের বয়স পঞ্চান্নর কাছাকাছি,আর একজন কম বয়সি একটি মেয়ে,বয়স ওই ছাব্বিশ সাতাশ।সাজগোজ পোশাক আশাক দেখে মনে হলো বেশ আধুনিক এবং ভালো ফ্যামিলিও বটে।কম বয়সি মেয়েটি মধ্য বয়স্কা মহিলাটিকে “মণি মা” বলে সম্বোধন করছে।”মণি মা” সম্বোধন শুনেই বুঝলাম দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা মা আর মেয়ের।পাশাপাশি বসে দুজনে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। কথা বার্তা শুনে যা মনে হলো কিছু দিনের মধ্যেই মেয়েটির বিয়ে।আর বিয়ের কেনা কাটা করেই ফিরছে দুজনে।ওদের কথা বার্তা গুলো শুনতে বেশ ভালোই লাগছিল।বিয়ের কেনাকাটা করার একটা আনন্দ তো আছেই।বিয়ের কেনাকাটার কথা বললেই নিজের বিয়ের কেনা কাটা করার কথা মনে পড়ে যায়।আমার বিয়ের বেনারসী কেনা হয়েছিল কলকাতার বেশ নামকরা দোকান থেকে।দুধে আলতা রঙের বেনারসীটা বার বার গায়ে ফেলে নিয়ে দেখে নিচ্ছিলাম কেমন লাগে।আমার সঙ্গে আমার মাও গিয়েছিল সেদিন।প্রতিটি মেয়ের কাছে বিয়ের বেনারসীটা খুব আবেগের।বিয়ের সাজে সেজে উঠতে বেনারসী শাড়িটাই নতুন করে রাঙিয়ে তোলে হয়তো।হঠাৎ করেই ওদের প্রতি আমার যে ভালো লাগাটা কাজ করছিল সেটারই ছন্দ পতন ঘটলো ওদের একটি কথায়।কানে এলো বিয়ের বেনারসীটা নাকি লাল রঙের কেনে নি।মেয়েটির ইচ্ছে কালো রঙের কোনো বেনারসী।তাই কালো রঙের বেনারসীই কিনেছে।মনের ইচ্ছেটা পূরণ হয়েছে বলে মেয়েটিও বেশ খুশী,সঙ্গে মেয়েটির মাও।কেন জানি না আমার খারাপ লাগতে শুরু করলো।বিয়ের মতো এমন একটা শুভ অনুষ্ঠান।কালো রঙটা ভীষণ অশুভ।বিয়েতে কালো রঙ চলে না।অথচ কালো বেনারসী পরে বিয়ে করবে।ভাবা যায়? ইচ্ছে হয়েছে বলেই কি কেনা যায়?মেয়েটির মায়েরও দেখলাম পূর্ণ সায় আছে।তাই তো কিনেছে।মেয়ের ইচ্ছে হতে পারে কিন্তু মা হয়ে এটা কি করে মেনে নিল সেটাই ভাবার।মায়ের আসকারা থাকে বলেই ছেলে মেয়েরা উচ্ছন্নে যায়।সে যাই হোক আমার এত না ভাবলেও চলে।মানুষ নিয়ম রীতি মানে না বলেই তো এত অধঃপতন।কালে কালে কত কি আর দেখব।ওদের মনে হয়েছে তাই ওরা কিনেছে।তাতে আমার কি?মা আর মেয়ে নানা কথা বার্তা বলে যাচ্ছে নিজেদের মধ্যে।আমার আর শুনতেই ভালো লাগছে না,ওদের বকবকানিটা বিরক্তিকর হয়ে উঠলো আমার কাছে।পোশাকে আশাকে আধুনিক যতই হোক রীতি নীতি মানতে হয় বই কি! এদিকে বাসে ভীড়টা আরো একটু বেড়ে গেল।ভীড় বাস মানেই ঠেলাঠেলি একটু হবেই।আর সেটাই হচ্ছে।আমাকে আরো এক ঘণ্টা যেতে হবে।সীট পাইনি যখন তখন দাঁড়িয়েই যেতে হবে,উপায় নেই।পরের বাসে গেলে হয়তো বসে যাওয়া যেত।কিন্তু আরো এক ঘণ্টা ওয়েট করতে হতো।কিন্তু বাড়ি ফেরার তাড়া।তাই দাঁড়িয়ে চলে যাব ভেবেই বাসে উঠেছি।হঠাৎ মেয়েটির মাকে বলতে শুনলাম, “-বাবলি সীটটা ছেড়ে দে।উনি মনে হয় অসুস্থ।সীটটা পেলে ওনার সুবিধা হবে।”সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি অন্য আর একজন মহিলা।ওনাকে দেখে অসুস্থই মনে হচ্ছে।সীট ছেড়ে দেওয়ার কথাটা শুনতে পেয়েই ওই মহিলাকে দেখলাম এগিয়েই আসতে।উনি বসবেন,তাই।বাসের মধ্যে অনেকেই আছেন।কেউ সীট ছাড়েন নি ওনাকে অসুস্থ দেখেও।সবাই যে যার মতো বসে আছেন অথচ মানবিকতা কারো মধ্যেই নেই সেটা বোঝা যায়।তা না’হলে সামনে যারা বসে আছেন তাদের মধ্যে যে কেউ সীট ছেড়ে দিতে পারতেন।মায়ের কথা শুনে মেয়েটি বলে, “-হ্যাঁ মণি মা।আমি দাঁড়িয়ে যেতে পারব।আমার অসুবিধা হবে না।এই যে আমার সীটটায় বসুন আপনি।” বলে মেয়েটি তার হাতের ব্যাগটা মায়ের কোলের ওপর রেখে আমার পাশে দাঁডায়।মেয়েটির সীটে ওই অসুস্থ ভদ্রমহিলাটি বসেন।এতক্ষণ ধরে মা ও মেয়ের মধ্যে যে এত কথা হচ্ছিল সেটার ছেদ পড়ে গেল।তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছেলেদেরকেই দেখি সীট ছেড়ে দিতে।আজ দেখলাম একটি মেয়েকে সেটা করতে।মা ও মেয়ের মধ্যে এই মানবিকতার কর্তব্য বোধ দেখে বেশ ভালো লাগলো।প্রকৃত শিক্ষাটা থাকে অন্তরে।তাই বাইরে থেকে কাউকে বিচার করাটাই ঠিক নয়।কালো বেনারসীর কথা শুনে যে খারাপ লাগাটা লাগছিল এমন কর্তব্য নিষ্ঠা দেখে মনটা সত্যিই ভরে গেল।মিনিট পনেরো পার হতেই অসুস্থ মহিলাটি বাস থেকে নেমে যেতেই মেয়েটি পুনরায় আবার নিজ সীটে বসতে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “-আপনি অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন‌।আপনি একটু বসুন।””-না না আমার অসুবিধা হচ্ছে না।তুমি বোসো।”মেয়েটির মা পাশ থেকে বলে, “-ও দাঁড়িয়ে যেতে পারবে।আপনি অনেক ক্ষণ থেকেই দাঁড়িয়ে আছেন,আপনি বসুন।”মেয়েটি এক প্রকার জোর করেই বসিয়ে দিল।সহযোগিতা ও সহানুভূতি যে মেয়েটির মধ্যে আছে সেটা দেখলেই বোঝা যায়।কিছু ভুল ধারণার জন্য আমরাও মানুষকে ভুল ভাবতে শুরু করি।তারপর মেয়েটির মা নিজে থেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “-আপনি যাবেন কোথায়?” “-আরামবাগ।” “-আমরাও তো আরামবাগ যাব।আরামবাগের কোথায় বাড়ি?””-প্রপার আরামবাগ নয়। আরামবাগ থেকে আরো পাঁচ কিলোমিটার ভিতরে।মেয়ের বিয়ের কেনা কাটা করতে গিয়েছিলেন বুঝি?””-হ্যাঁ।বিয়ের কেনাকাটা।””-একটা কথা জিজ্ঞেস করব যদি কিছু মনে না করেন?””-নিশ্চয়ই।মনে আর কি করব,আপনি বলতে পারেন?””- মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন তা বিয়েতে কালো বেনারসী কেন?জানেন তো লাল রঙটা কিন্তু শুভ।লাল রঙের বেনারসী পরাটাই কিন্তু রীতি।””-না না আমরা ওসব মানি না। লাল রঙ যদি শুভ হতো তাহলে সব কিছুই শুভ থাকত ওর জীবনে।””-মানে?বুঝলাম না ঠিক?” “-আসলে এটা ওর সেকেণ্ড ম্যারেজ। প্রথম বার বিয়েতে আমিই ওকে বলেছিলাম বিয়েতে লাল টকটকে বেনারসী পরতে।লাল রঙটাই নাকি শুভ। লাল রঙের বেনারসীতে ওকে সুন্দর মানিয়েও ছিল।কিন্তু কোথায় গেল সেই লাল রঙ?দেড় বছরের মাথায় হারিয়ে ফেললো প্রিয় মানুষটাকে।তাই আর শুভ অশুভ কিছু দেখি না।ওর ভালো থাকাটাতেই আমার ভালো থাকা।””-সত্যি খুব দুঃখ জনক।জিজ্ঞেস করে কষ্ট দিয়ে ফেললাম। কিছু মনে করবেন না‌।আপনার তাহলে এই একটি মাত্রই মেয়ে?””-বাবলি আমার মেয়ে নয়।আমার ছেলের বৌ।তবে বাবলি এখন নিজের মেয়ের থেকেও অনেক বেশি।বাবলি বিয়ের আগে থেকেই আমাদের বাড়ি আসতো।আমার ছেলের সাথে প্রেম করেই ওর বিয়ে‌।বিয়ের আগে থেকেই ও আমাকে মণি মা বলে ডাকে।এই বন্ধনটা বহু দিনের।আমার ছেলের মতো বাবলিও আমার আর এক সন্তান। নিয়তির কি পরিহাস দেখুন।ছোট্ট একটা দুর্ঘটনায় আমার ছেলে মারা গেল।তারপর থেকে আমিও একা হয়ে গেলাম‌।আর মেয়েটা জীবনের সব সাধ হারিয়ে ফেললো।আমি তো ছেলেকে হারিয়েই ফেলেছি।তাই মা হয়ে আমি সব কষ্ট মেনে নিয়েছি।কিন্তু ওই টুকু একটা মেয়ের এই বয়সে যে এমন অঘটন ঘটবে সেটা ভাবতেও পারিনি।সুস্থ লাইফে ফেরানোর জন্য আমি সব সময়েই চেষ্টা করে গেছি ওর পাশে থেকে।মনের জোরটাই বড়ো কথা।গ্রাজুয়েশনের পর আমিই ওকে মাস্টার্সটা কমপ্লিট করাই।এই বছর খানেক হলো ও একটা চাকরিও পেয়েছে।আমি তো ওর জন্যই ভালো আছি।মানে আমাকে ভালো থাকতে হয় আর কি।””-তাহলে ও আপনার কাছেই থাকে?” “-হ্যাঁ আমার কাছেই থাকে।মাঝে মধ্যে মামার বাড়িতে যায়।মামা মামী ছাড়া আর তো নিজের কেউ নেই। মা তো সেই কোন ছোটো বেলায় মারা গেছেন। মা মারা যাওয়ার পর থেকে মামার বাড়িতেই ও মানুষ হয়েছে।তবে মামা মামীও ভীষণ ভালো।আর আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না‌।এই সামনের ফাল্গুনে ওর বিয়ে।আমিই ওর বিয়েটা দিচ্ছি।ওর তো সারা জীবনটা পড়ে আছে।একজন জীবন সঙ্গীর খুব প্রয়োজন।আর বলছিলেন না কালো বেনারসী কেন বিয়েতে?রঙ দিয়ে কখনো শুভ অশুভ বিচার হয় না।যে রঙটা ওর পছন্দ সেই রঙের বেনারসীটাই ও পরুক।ওর ভালো থাকাতেই যে আমার সুখ।”কথা বলতে বলতে কখন যে আরামবাগ পৌঁছে গিয়েছি তা আর খেয়াল নেই।বাস থেকে নামি।শুধু ভালো লাগা নয়,সব কিছু শুনে একটা ভালোবাসা তৈরিও হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গেই।কেন জানিনা কিছুক্ষণের পরিচয়টা অনেক বেশি দিনের পরিচিত বলেই মনে হচ্ছিল‌।ওনারা বাস থেকে নামেন।তারপর ওই ভদ্র মহিলা ওনার মোবাইল নাম্বারটা আমাকে দিয়ে বলেন, “-কথা বলে খুব ভালো লাগলো।সময় করে ফোন করবেন‌।অনেক কথা হবে।আজ দশ বছর কেটে গেছে।ভদ্র মহিলার সাথে এখনো যোগাযোগ আছে।যোগাযোগ বলব না,রীতি মতো আত্মীয়তার সম্পর্ক।আমি ওনাকে দিদি বলেই ডাকি।মানসিকতার দিক থেকে এতটা উচ্চ মনের ওনার সঙ্গে না মিশলে বুঝতেই পারতাম না।আর বাবলি আমাকে মাসি বলে‌।বাবলির বিয়েতে আমরা সকলেই গিয়েছিলাম।বিয়েতে কালো বেনারসীই পরেছিল‌ ও।আর দশ বছরের বিবাহিত জীবন ভালোই কাটছে ওদের।এক কথায় সুখী জীবন বলা যেতে পারে।জীবনের কোনো রঙ হয় না বোধ হয়।যে রঙে রাঙাবে সেই রঙেই জীবন রঙীন,সে লালই হোক বা কালো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *