প্রথম পর্ব
ছোট থেকেই ভীষণ উচ্চাকাঙ্খী প্রিয়াঙ্কা! একদম ছোটবেলায় সেরকম কিছু না বুঝলেও জ্ঞান হওয়ার সাথে সাথেই ওর মনে একটা বড় হওয়ার সুপ্ত ইচ্ছা জন্ম নেয় আর সময়ের সাথে সাথে সেই ইচ্ছা আরও বেশি ডানা মেলার জন্য ছটফট করতে থাকে! মা-বাবার একটাই মেয়ে! তাতে বাবা, শেখর চ্যাটার্জী কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে ভালো পদে কাজ করেন! মা উচ্চশিক্ষিতা! প্রিয়াঙ্কার বাবাও উচ্চাভিলাষী! মূলত উনিই প্রিয়াঙ্কাকে উঁচু স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলেন। তিনি চাইতেন মেয়ে যেন একজন নাম করা ডাক্তার হয়, কারণ পরিবারে আজ অব্দি কেউ ডাক্তার হতে পারেনি! প্রিয়াঙ্কাও মনে প্রাণে ডাক্তার হতে চেয়েছিল। ক্লাস ৬ এ পড়াকালীনই সে মনস্থির করে নেয় যে তাকে ডাক্তারই হতে হবে। আর ক্লাস ৮ এ পড়াকালীন সময় থেকে জীবন বিজ্ঞানকে জীবনের মূলমন্ত্র করে নিয়েছিল! জীবনবিজ্ঞান সম্পর্কিত সবকিছুকে তখন থেকেই রপ্ত করতে শুরু করে সে! এরপর সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষার দোরগোড়ায় এসে পড়ে প্রিয়াঙ্কা! মাধ্যমিক পরীক্ষা! বাকি সব বিষয়ে যথেষ্ট ভাল হলেও অঙ্ককে চিরকাল ভয় পায় প্রিয়াঙ্কা! একবার তো ক্লাস ৭ এর বার্ষিক পরীক্ষায় অঙ্কে এত খারাপ ফল হয়েছিল যে সব শিক্ষকরা অবাক হয়ে গেছিলেন যে বাকি সব বিষয়ে এত ভাল ফল করেও অঙ্কে এত খারাপ হয় কি করে! এবার সবাইকে বোঝাবে কি করে সে যে অঙ্ক করতে তার একদমই ভাল লাগেনা! ভূগোল পড়তে পড়তে কত নতুন জায়গাকে চেনা যায়! বেড়াতে বরাবর ভালবাসে সে, তাই ভূগোলও ভাল লাগে! ইতিহাসের পাতায় পাতায় কত রহস্য, কত অতীত! রোমাঞ্চ লাগে! পদার্থ বিজ্ঞানও বেশ ভালই লাগে! আর বাংলা, ইংরাজি মোটের উপর খারাপ লাগেনা! কিন্তু অঙ্ক! না! অঙ্কটাকে কিছুতেই ভালবাসতে পারেনা সে! রসকষহীন বিষয় একটা! আর জীবন বিজ্ঞানের তো নামেই জীবন আছে! শুধু নাম্বারের জন্য নয়, এই বিষয়টা সে ভালবেসে পড়ে! যাই হোক বোর্ড তো আর তার ভাললাগা খারাপলাগা মেনে সিলেবাস করবে না! তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও অঙ্কটা করতে হচ্ছে ভালভাবে প্রিয়াঙ্কাকে! ওর মা বাকি বিষয়গুলো দেখিয়ে দিলেও, অঙ্কে ভীতির জন্য একজন টিচার রাখতেই হয়েছে। প্রিয়াঙ্কার মা নন্দিনী দেবী এমনিতেও প্রিয়াঙ্কাকে কখনই পড়াশুনার ব্যাপারে কোন জোর করেননি যে স্ট্যান্ড করতেই হবে! উনি নিজে ভীষণ মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। ওনার বাবা ছিলেন না! দাদার কাছেই মানুষ হয়েছিলেন! তাই মন প্রাণ দিয়ে পড়াশুনা করে জীবনে ছোটখাটো হলেও কিছু একটা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন! কিন্তু হায় রে ভাগ্য! সব যোগ্যরা যদি যোগ্যতার দাম পেয়ে যেত তাহলে হয়তো এই পৃথিবী স্বর্গ হয়ে যেত! যে নন্দিনী ব্যানার্জী জীবনে কোনদিন ২য় হয়নি, সে যখন একজন হাউসওয়াইফ হয়েই থেকে গেল তখনই সে বুঝতে পেরেছিল যে জীবনে কিছু করতে গেলে প্রথম দ্বিতীয় হওয়ার দরকার পড়েনা! এই কথাটা উনি মেয়েকেও বোঝাতে চাইতেন! লক্ষ্য স্থির রাখো কিন্তু সব কিছু ছেড়ে শুধু তারই পিছনে ছুটলে ভালভাবে কখনই বাঁচা যায়না! প্রিয়াঙ্কা এসব বুঝত না! সে স্কুলে ভাল ছাত্রী ছিল কিন্তু কখনো প্রথম হতে পারতোনা! আর সেই নিয়ে একটা ক্ষোভ রয়েই গেছিল ওর মনে। ও চাইতো সবাই ওকে এক নামেই চিনবে! যখন স্কুলে প্রাইজ দেওয়া হত প্রিয়াঙ্কার নজর থাকতো সেই প্রথম প্রাইজের দিকেই! অথচ অঙ্কে ভাল নাম্বার না থাকায় ওই একটা বিষয়ের জন্য অনেকটাই পিছিয়ে পড়ছিল সে! “ অসহ্য! একেবারে অসহ্য একটা সাবজেক্ট! কবে যে এর থেকে রেহাই পাবো কি জানি!” গজ গজ করতে করতে অঙ্ক করছিল প্রিয়াঙ্কা। “কি হল বাবু?” রান্না ঘর থেকেই জিজ্ঞেস করলেন নন্দিনী দেবী। প্রিয়াঙ্কা কোন জবাব দিল না। নন্দিনী দেবী বেরিয়ে এলেন রান্নাঘর থেকে, প্রিয়াঙ্কার কাছে এসে বললেন “পিউ, অঙ্কটা ভালভাবে প্র্যাকটিস কর তাহলেই পেরে যাবি! অঙ্ক ছাড়া ভাল নাম্বার পাওয়া যাবে না দেখছিস তো!” মায়ের কথায় মুখ ফিরিয়ে বলল প্রিয়াঙ্কা “ সে কি আর জানিনা মা! এই ফালতু বিষয়টার জন্যই আমার ওভারওল রেসাল্ট খারাপ হয় প্রতিবার! এমনিও এই বছরটাই আমাকে জান প্রাণ দিয়ে খাটতে হবে! তারপর ক্লাস ১১ এ আমি কিছুতেই পিওর সাইন্স নেবনা! তুমি বাবাকে বলে দিও আগে থাকতেই! এমনিও আমি মেডিক্যাল পড়ব, তাই এই অঙ্ক আমার রাখার দরকারও নেই!” “ঠিক আছে সে দেখা যাবে! আগে মাধ্যমিকটা ভালভাবে দে! চিন্তা করার কিছু নেই” হাল্কা হেসে বললেন নন্দিনী দেবী।
“ অঙ্কে ৯০%! অসাধারণ প্রিয়াঙ্কা! শেখরদা, আমি আপনাকে বলেছিলাম না প্রিয়াঙ্কা ভীষণই পরিশ্রমী! এর ফল পেতই” উৎফুল্লিত হয়ে বললেন মিস্টার প্রবীর সেন, প্রিয়াঙ্কার অঙ্কের প্রাইভেট টিচার। “রেসাল্ট খুব ভাল হয়েছে! স্টার মার্কস! অঙ্কটা তুমি করালে বলেই কিন্তু ওর এতটা উন্নতি হল! তোমার অবদান কম নয় প্রবীর!” হেসে বললেন প্রিয়াঙ্কার বাবা মিস্টার শেখর। প্রবীর সেন প্রিয়াঙ্কার বাবার সাথেই কাজ করেন। অঙ্কে মাস্টার্স! এমনি সেইভাবে টিউসনি করেননা প্রবীর, কিন্তু প্রিয়াঙ্কার বাবার সাথে ভাল সম্পর্ক থাকায় ওনাকে না করতে পারেননি! প্রিয়াঙ্কা মেয়েটা ভীষণ সিনসিয়ার! শুধু অঙ্কে ভীতির একটাই কারণ ছিল প্র্যাকটিসের অভাব! যাই হোক শেষের দিকে ভালই প্রাকটিস করেছে! প্রবীরবাবু অনেকগুলো পরীক্ষা নিয়ে ওকে পরীক্ষার জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন! কিন্তু মেয়েটার অঙ্কের প্রতি একটা উদাসীনতা আছে! যাই হোক ফল এত ভাল করতে পেরেছে প্রিয়াঙ্কা এতেই খুশি লাগছে প্রবীরবাবুর!
প্রিয়াঙ্কার মনে শান্তি নেই! প্রায় সব বিষয়ে ৯০% করে নাম্বার পেয়েও প্রথম হতে পারলো না! ও তো এটাও শুনেছে যে ওর অনেক ক্লাসমেট অঙ্কে ১০০ তে ১০০ পেয়েছে! শুনে আরও রাগ হচ্ছিল প্রিয়াঙ্কার! তাও সে মেনে নিত যদি না শুনত যে ওদের ব্যাচের ছেলেদের স্কুলের টপার শুভেন্দু জীবন বিজ্ঞানে ১০০ তে ১০০ পেয়েছে! আর প্রিয়াঙ্কা ৯৫। মানা যায়! রাগের চেয়েও বেশি দুঃখ হচ্ছিল প্রিয়াঙ্কার! আর বার বার মনে করার চেষ্টা করছিল সে যে কি এমন ভুল করে এল যে পাঁচ নাম্বার কম এল! যদিও ওদের স্কুলের জীবনবিজ্ঞানের স্যার শুনে বলেছেন যে প্রিয়াঙ্কাও ১০০ ই পাওয়ার মত কিন্তু তাতে কি হয়! পায়তো নি! এদিকে প্রিয়াঙ্কার মা বেশ খুশি মেয়ের রেসাল্টে! উনি খুশি হয়ে সবাইকে জানাচ্ছেন! প্রিয়াঙ্কার মন এদিকে কিছুতেই ঠিক হচ্ছে না! একটা না পাওয়ার জ্বালা যেন! যেন একটা সুযোগ চলে যাওয়া!
“তুমি পিওর সাইন্সেই ভর্তি হবে পিউ! পিওর সাইন্স ছাড়া সাইন্স পড়ার কোন মানেই নেই!” বললেন প্রিয়াঙ্কার বাবা। “ কিন্তু বাবা আমি ওই অঙ্কটাকে আর রাখতেই চাইনা! আমার দ্বারা অঙ্কটা হবেই না আর….” প্রিয়াঙ্কাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বললেন শেখরবাবু “ দেখ মা! সাইন্সের কোন বিষয়ই অঙ্ক ছাড়া বোঝা সম্ভব হবে না!” “ঠিক আছে তাহলে সাইডে রাখি!” আমতা আমতা করে বলল প্রিয়াঙ্কা। “একই ব্যাপার তো! সাইডে বায়োলজিটা রাখ আর পড়ার সময় মেন সাবজেক্টের মত করেই পড়বি! সাইন্সটাও পিওর থাকবে আর সব সাবজেক্টে সমানভাবে ফোকাসও করা হবে! তাই না!” স্মিত হেসে বললেন শেখরবাবু। প্রিয়াঙ্কা আর কিছু বলল না। পিওর সাইন্স নিয়ে ১১ এ ভর্তি হয়ে গেল।
“খুব আজকাল সেধে সেধে কথা বলে তোর সাথে! ব্যাপার কি?” মুচকি হেসে বলল শ্রীতমা। “কে কথা বলে?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল প্রিয়াঙ্কা। “কে আবার! দীপাঞ্জন” বলল শ্রীতমা। “ও আচ্ছা ওই বাচালটা? ওই কেমিস্ট্রি ব্যাচে হায়েসট নাম্বার পাওয়ার পর থেকেই পিছন পিছন ঘুর ঘুর করছে! ইগনর!” পাশ কাটানোর চেষ্টা করল প্রিয়াঙ্কা।শ্রীতমা আর কিছু বলল না। জানে এখন বেশি কিছু বলতে গেলেই প্রিয়াঙ্কা বলবে যে “ এসব বন্ধ কর শ্রী…আমার এখন এসব শোনার সময় নেই…আমাকে মেডিক্যালে ফোকাস করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি…”। তাই কথা না বাড়িয়ে অন্য কথা শুরু করল।
“ হাই! প্রিয়াঙ্কা রাইট?” ম্যাথের ব্যাচ থেকে পড়ে বেরনোর সময় পিছন থেকে নিজের নামটা শুনে ঘুরে তাকাল প্রিয়াঙ্কা। “হাই! আঙ্কেল নিতে আসবেন নাকি?” হেসে জিজ্ঞেস করল দীপাঞ্জন। “ হ্যাঁ” সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল প্রিয়াঙ্কা। “ বলিস তো ছেড়ে দিয়ে আসতে পারি তোকে, যাবি?” তাকিয়ে রইল দীপাঞ্জন। “ না রে! ঠিক আছে। লাগবে না। বাবা এখনি আসবে” হালকা হেসে বলল প্রিয়াঙ্কা। এরপর প্রায় দিনই কোননা কোন অজুহাতে দীপাঞ্জন প্রিয়াঙ্কার সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজতে লাগলো। প্রিয়াঙ্কা টুকটাক করে জবাব দিত।কিন্তু একদিন একজন বান্ধবীর মারফত জানতে পারে যে দীপাঞ্জন ওকে প্রপোস করবে! ব্যাস! ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই প্রিয়াঙ্কা দীপাঞ্জনকে ইগনর করতে শুরু করে! ওর মোটেও এসব ভাল লাগতো না! এই পিক পিরিয়ডে এসব উটকো জিনিস একেবারেই মেনে নেওয়া যাবে না! যাই হোক এরপর বেশ কিছুদিন পরে ও জানতে পারে যে দীপাঞ্জনের গার্লফ্রেন্ড হয়েছে! একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল প্রিয়াঙ্কা।
এইভাবেই দেখতে দেখতে ক্লাস ১১ এর পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। এরপর পড়াশুনার চাপ বাড়তে থাকে! সামনেই ১২র ফাইনাল পরীক্ষা! আর তারপর জয়েন্ট। প্রিয়াঙ্কা নিজেকে তৈরি করতে থাকে মেডিক্যাল জয়েন্টের জন্য। ওর ইঞ্জিনিয়ারিং জয়েন্ট দেওয়ার ইচ্ছা একদমই নেই! তা সত্ত্বেও বাবা বলেছে একবার বসতে পরীক্ষাটাতে। যাই হোক এখন আপাতত ১২র ফাইনাল নিয়ে চিন্তা প্রিয়াঙ্কার! যদিও অঙ্কটাতে এখন আর অতটাও দুর্বল নেই সে! বেশ ভালোই পারে এখন আসলে! কিন্তু তাও, অঙ্কতে একদম ইন্টারেস্ট নেই প্রিয়াঙ্কার। কারণ শেষ অব্দি সে মেডিক্যালে যাবেই! অতএব অঙ্কর পাট এই ১২এই শেষ! তাই চিন্তা নেই আর!
দ্বিতীয় পর্ব –
“আমার কিছু ভালো লাগছে না মা! প্লিস একটু একা থাকতে দাও আমাকে” কান্নাভেজা গলায় বলল প্রিয়াঙ্কা। নন্দিনী দেবী আর কিছু বললেন না। স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা সম্পর্কে উনি ভালমতোই অবগত! তাই আর বিরক্ত করলেন না প্রিয়াঙ্কাকে।
জানলার দিকে অপলক তাকিয়ে বসে আছে প্রিয়াঙ্কা। আজকে জয়েন্টের ফলাফল বেরিয়েছে! আর প্রিয়াঙ্কা মেডিক্যাল ক্লিয়ার করতে পারেনি! এই কষ্ট প্রথম হতে না পারার কষ্টের থেকেও বহুগুণ বেশি করে বিঁধছে বুকের মধ্যে! একটা শূন্যতা! সব কিছু শেষ হয়ে যাওয়ার মত মনে হচ্ছে! উচ্চমাধ্যমিকের আগে আগেই প্রিয়াঙ্কার বাবার একটা সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাক হয়! তাই এমনিতেও বেশ ডিস্টার্বড ছিল সে! তাতে জান প্রাণ দিয়ে জয়েন্টটা দিয়েও এতগুলো বছর ধরে দেখা স্বপ্নটা যখন এক লহমায় ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেল তখন সেই দুঃখ সামাল দেওয়ার মত কিছু উপায় মাথায় আসছিল না প্রিয়াঙ্কার! এবার কি করবে সে? বাবার শরীর ভাল নেই! তার উপর সে শুধু নিজের নয় তার বাবারও এত দিনের স্বপ্নকে ভেঙ্গে দিয়েছে! নিজের উপর একটা ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিল প্রিয়াঙ্কার! এতদিনের এত ভালভাবে পড়ার কি কোনই মূল্য নেই? মা বলছে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে! বাবাও এখন তাই বলছে! কিন্তু…। সে তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চায়না! আর তাছাড়া ইঞ্জিনিয়ারিং জয়েন্টটাও দেওয়ার ইচ্ছা ছিলনা তার! বাবা-মা জোর করেই দুটোরই ফর্ম ভরানো করিয়েছিল। পরীক্ষার আগেও বলছিল যে অঙ্কর পেপারটা দেবে না! বাবা বুঝিয়ে দেওয়ানো করিয়েছিল। কিন্তু পেপারটা ভাল হয়ওনি! ফলস্বরূপ ইঞ্জিনিয়ারিংএ র্যাঙ্ক এসেছে অনেক পিছনের দিকে! অদেও কোন কলেজে চান্স পাবে কিনা ঠিক নেই! আর পেলেও বা! অঙ্ক ছাড়া ইঞ্জিনিয়ারিং হবেই না! আর এই অঙ্কতে কোন ভাবেই ইন্টারেস্ট আসেনা প্রিয়াঙ্কার! কি করবে এই ভেবে ভেবেই সারাদিনই প্রায় কান্নাকাটি করে সে! নন্দিনী দেবী বুঝিয়েও পারছেন না!
“মা! বলছি কি যে আমি যদি প্রেসিডেন্সিতে ফিজিক্সে অনার্স পেয়ে যাই তাহলে ওটা নিয়েই ভর্তি হয়ে যাব বুঝলে!” আস্তে আস্তে বলল প্রিয়াঙ্কা। “ঠিক আছে তবে তাই কর” বললেন নন্দিনী দেবী। “পাসে অঙ্ক রাখবনা কিন্তু! বায়োলজি রাখবো!” প্রিয়াঙ্কার কথা শেষ হতে হতে শেখরবাবু ঘরে এসে ঢুকলেন। তারপর বললেন “ অঙ্ক ছাড়া তো ফিজিক্স পড়ে লাভ নেই।“ প্রিয়াঙ্কা চুপ করে গেল। ওর শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে ওর বাবা বললেন “ ঠিক আছে রে মা! তোর যেটা পড়ার ইচ্ছা সেটাই পড়! কোন জোরজবরদস্তি নেই, কেমন?” প্রিয়াঙ্কা কান্না আটকে আলতো করে মাথা নাড়াল।
“ আর মন খারাপ করিস না রে বাবু! যা হওয়ার হয়ে গেছে! এবার আগে কি করবি সেটা ভাবনা চিন্তা করতে হবে” প্রিয়াঙ্কার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন নন্দিনী দেবী। দুদিন আগেই প্রিয়াঙ্কাদের উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল বেরিয়েছে! অঙ্ক ছাড়া বাকি সব বিষয়তেই খুব ভাল ফল করেছে সে! আর অঙ্কে নাম্বার কম আসাতে প্রেসিডেন্সিতে ফিজিক্সে অনার্স পেলনা সে! প্রিয়াঙ্কা একটা জিনিস বুঝতে পারছিল না যে যখন অঙ্কে খুব খারাপ ছিল তখন ৯০% পেল। আর যখন একটু ভাল হতে শুরু করলো তখন ৬৫% পেল! অদ্ভুত! এখন রাগটা অসহায়তাতে পরিণত হয়েছে! সে বুঝে উঠতে পারছে না যে কি করবে! প্রিয়াঙ্কার খুব ইচ্ছা করছিল যে রাজস্থানের কোটা থেকে আগামী এক বছর মেডিক্যালের কোচিং করতে! বাবা-মাকে বললেন রাজিও হয়ে যাবেন ওনারা! কিন্তু একটা জড়তা লাগছিল তার! বাবাকে ভি আর এস নিতে হয়েছে শারীরিক অসুবিধার জন্য! তার উপর এতগুলো ধাক্কা খেলেন প্রিয়াঙ্কারই জন্য! আবারও খুব কান্না পেল প্রিয়াঙ্কার! না! সবসময় নিজের কথা ভাবলেই চলবে না! সে না হয় ইঞ্জিনিয়ারিংএই ভর্তি হয়ে যাবে! তারপর নেক্সট ইয়ার আর একবার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তেই না হয় মেডিক্যাল জয়েন্টটা দেবে! এতে মা –বাবার মনে এইটুকু শান্তি থাকবে যে মেয়ে একটা লাইন নিয়ে পড়া শুরু করেছে! চোখের জল মুছে বাবার ঘরে গিয়ে ঢুকল প্রিয়াঙ্কা। একটু ইতস্তত করে বলল “ বাবা! আমি ইঞ্জিনিয়ারিংএর কাউন্সিলিংএ যাব!” শেখরবাবু একটু পেপারটা দেখছিলেন। সেটাকে পাশে রেখে বললেন “ তুই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বিনা বলছিলিস যে মা? কোথাও যদি কোচিং…” “না বাবা! কোচিং করবোনা! বরং পরের বছর একবার মেডিক্যালটা দেব!” বলে উঠল প্রিয়াঙ্কা। “ঠিক আছে! আমার সাথে আজকে সাইবারে চল তবে! কাউন্সিলিং তো আজ থেকেই শুরু হচ্ছে নাকি?” বললেন শেখরবাবু। “আজ না পরশু থেকে শুরু হচ্ছে বাবা!” হাল্কাভাবে বলল প্রিয়াঙ্কা। “ঠিক আছে” হেসে বললেন শেখর বাবু।
সেইসময়ে সবে সবে ইন্টারনেটের রমরমা শুরু হয়েছে! প্রিয়াঙ্কাদের ব্যাচটাই ছিল সম্ভবত জয়েন্টের প্রথম অনলাইন কাউন্সিলিংএর ব্যাচ। সেইসময় ইন্টারনেট বাড়িতে বাড়িতে আসা শুরু হয়নি। তাই ইন্টারনেট সংক্রান্ত যাবতীয় কাজকর্মের জন্য তখন সাইবারগুলোই ভরসা ছিল। প্রিয়াঙ্কা বাবার সাথে এসেছে সাইবারে অনলাইন কাউন্সিলিংএর জন্য। সাইবারের দাদাটা বুঝিয়ে দিচ্ছে কিভাবে কি করতে হবে! চয়েজ ফিলিং শেষ করে ফিরে এল দুজন বাড়িতে। এবার অপেক্ষা প্রথম কাউন্সিলিংএর ফল প্রকাশের!
“ বাড়ির কাছের কলেজগুলো দিয়েছিলিস? দুর্গাপুরের কলেজগুলো?” জিজ্ঞেস করলেন নন্দিনী দেবী। “হ্যাঁ দিয়েছিলাম! কিন্তু হয়নি! এই দুর্গাপুরের কলেজগুলোতেও যা র্যাংক দরকার সেটা আমার নেই!” অন্যদিকে তাকিয়ে বলল প্রিয়াঙ্কা। “কলকাতা সাইডের কলেজগুলো দিয়ে দিস তো মা এবার সেকেন্ড কাউন্সিলিংএ! ওই দিকে অনেক কলেজ আছে তো সম্ভাবনাও বেশি আছে!” বললেন শেখর বাবু। “হ্যাঁ ওইটাই ভাল! আরে এর থেকেও নিচে র্যাংক কি আর কারুর নেই? আর শুভেন্দু আর তোর বাকি বন্ধুদের কি খবর? ওরা সব ইঞ্জিনিয়ারিংএ ভর্তি হচ্ছে নাকি এমনি অনার্সে?” জিজ্ঞেস করলেন নন্দিনী দেবী। “আমি কারুর কোন খবর জানিনা আর জানতেও চাইনা!” বেশ বিরক্ত হয়ে পাশের রুমে চলে গেল প্রিয়াঙ্কা।
“ কলেজটা গ্রেটার কলকাতাতে ঠিক নয়! একটু ভিতরের দিকে! কিন্তু আমি দেখে এলাম, খারাপ লাগলো না! বেসরকারি প্রায় সব কলেজই কম বেশি একই রকম হয়” ঢুকতে ঢুকতে বললেন শেখরবাবু নন্দিনীদেবীকে। প্রিয়াঙ্কা অবশেষে শেষ কাউন্সিলিংএ একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চান্স পেয়েছে! কিন্তু কলেজটা একদমই অনামি কলেজ! শুনে থেকেই প্রিয়াঙ্কার মেজাজটা খিঁচরে আছে! সে জানতো যে ভাল কলেজ পাওয়ার মত র্যাঙ্ক তার নেই! তথাপি কেন জানিনা মন মানছিল না এরকম একটা অনামি কলেজে ভর্তি হতে! বিরক্তিতে কলেজটা দেখতেও যায়নি সে! ওর বাবা গিয়ে দেখে এলেন আজকে। হস্টেলেই থাকতে হবে প্রিয়াঙ্কাকে। বাড়ি থেকে মানে দুর্গাপুর থেকে যাতায়াতের প্রশ্নই ওঠেনা! যাই হোক মনে এক রাশ বিরক্তি আর ক্ষোভ নিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল একদিন সে মা বাবার সাথে।
“মা! এটা হোস্টেল?” নাক কুঁচকে বলল প্রিয়াঙ্কা। “ কিছু করার নেই বাবু! এই জায়গাটাই এমন যে আশে পাশে সেরকম মেয়েদের মেসও নেই ! হোস্টেলেই থাকতে হবে কষ্ট করে!” আস্তে আস্তে বললেন নন্দিনী দেবী। যেহেতু মেয়েদের হোস্টেল তাই শেখরবাবুকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি! নন্দিনী দেবী ভিতরে এসেছেন প্রিয়াঙ্কার সাথে। প্রিয়াঙ্কার কান্না পাচ্ছিল। সব কিছু ভীষণ নন স্ট্যান্ডার্ড মনে হচ্ছিল! এইরকম জায়গায় এসে পড়তে হবে স্বপ্নেও ভাবেনি সে! রাগের চোটে সেদিন রুমমেটদের সাথেও ঠিক করে কথা বলল না! ক্যান্টিনে রাতের খাওয়ার খেতে গিয়ে দেখল পোড়া রুটি,বিচ্ছিরি আলু ভাজা, জলের মত ডাল। এসব দেখে আরও কান্না পাচ্ছিল তার! সাথে নিজের অসফলতার জন্য নিজের উপর প্রচণ্ড রাগও হচ্ছিল! এখানে ৪ বছর কিভাবে থাকবে সে?
সেদিন রাতে ঘুম এলনা প্রিয়াঙ্কার! খুব খুব কান্না পাচ্ছিল! এইভাবে নিজেকে হেরে যেতে দিতে পারেনা সে! না! ভালভাবে পড়াশুনা করতে হবে যাতে এরপর ভাল জায়গায় যেতে পারে সে! নিজের খামতি গুলোকে ঠিক করতে হবে! উঠে বসে প্রিয়াঙ্কা! মুখে চোখে জল দিয়ে আসে! তারপর সেইদিনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে যে এরপর সে ভাল জায়গায় নিজেকে নিয়ে যাবেই, যে কোরেই হোক! ভাল কলেজ পেলনা ঠিকই কিন্তু এরপরের ধাপগুলোতে সে নিজেকে উপরে উঠিয়ে নিয়ে যাবে! আর এই লড়াইটা তার আজ থেকেই শুরু হল! পূবের আকাশ তখন ফরসা হতে শুরু করেছে! প্রিয়াঙ্কা রুম থেকে বেরিয়ে এল ব্যাল্কনিতে! ভোরের আকাশের দিকে সজল চোখে তাকিয়ে নিজের মনেই বলে উঠলো “ আমি আমার যোগ্য জায়গায় নিশ্চয় পউছাব! সেটা আজ না হলেও এক না একদিন হবেই।“
তৃতীয় পর্ব
কলেজ জীবন শুরু হয় প্রিয়াঙ্কার। আস্তে আস্তে এই পরিবেশেই নিজেকে মানিয়ে নিয়ে পড়াশুনায় মনোযোগ দেয় সে! যদিও হোস্টেল আর কলেজের প্রায় সবার সাথেই বেশ ভালই বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছু একটা ছিল যেটা মাঝেমধ্যেই প্রিয়াঙ্কাকে কষ্ট দিত! সেটা মা-বাবাকে ছেড়ে প্রথমবারের জন্য দূরে থাকার কষ্ট নাকি সেই মন ভেঙ্গে যাওয়ার ক্ষত সেটা সে বুঝতে পারতো না! বন্ধুদের সাথে থাকলে বলতে নেই সে বেশ খুশিই থাকত। রুমমেটরা বেশ ভাল এবং বন্ধুসুলভ। তাই কিছুদিনের মধ্যেই ওরা চারজন রুমমেট বেশ ঘুলেমিলে গেছিল। একসাথে ছুটির দিনে ঘুরতে যাওয়া, খাওয়া দাওয়া করা আরও কতকি! যদিও ডিপার্টমেন্ট সবার আলাদা আলাদা ছিল কিন্তু তা সত্ত্বেও চারজনের বেশ মিল ছিল! কিন্তু যখন প্রিয়াঙ্কা একা থাকতো, তখন সেই না পাওয়াগুলো ঘিরে ধরত ওকে! কত রাত কেঁদে কাটিয়েছে তার ঠিক নেই! বলতেই বলে সময় সব কিছুকে ভুলিয়ে দেয়! আসলে ভুলিয়ে ঠিক দেয়না, আবছা করে দেয়! তাই দ্রুতবেগে বয়ে চলা সময়ের সাথে সাথে মনের ক্ষতটাও খানিক আবছা হতে শুরু করে প্রিয়াঙ্কার! দেখতে দেখতে প্রথম সেমিস্টারের পরীক্ষা চলে আসে! আর সেটা ছিল প্রিয়াঙ্কার কাছে তার নতুন লড়াইয়ের প্রথম পর্ব!
“ হ্যালো অনিতা? আমি প্রিয়াঙ্কার মা বলছি রে! প্রিয়াঙ্কা ফোন তুলছে না কেন রে বাবু?” উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন নন্দিনী দেবী প্রিয়াঙ্কার রুমমেট অনিতাকে। অনিতা একটু থেমে নিয়ে বলল “ আসলে আন্টি আজকে আমাদের সেমিস্টারের রেসাল্ট বেরিয়েছে! তাই প্রিয়াঙ্কা একটু আপসেট আছে! দাঁড়ান আমি ওকে ফোনটা দিচ্ছি” বলে অনিতা প্রিয়াঙ্কাকে ফোনটা দিয়ে বলল “ নে কথা বল! আন্টি কথা বলবেন! ফোনটাকে অফ করে রেখেছিস কেন? নে নে কথা বল।“ “হ্যালো!?” প্রিয়াঙ্কার গলার আওয়াজ পেয়ে নন্দিনী দেবী বললেন “ কিরে বাবু! ফোনটাকে কেউ অফ করে রাখে? কত চিন্তা হয় বলতো!” “ মনে হয় ব্যাটারিটা শেষ হয়ে গেছে তাই অফ হয়ে গেছে ফোনটা!” ভারী গলায় বলল প্রিয়াঙ্কা। নন্দিনী দেবী বুঝতে পারছিলেন যে এতক্ষণ কাঁদছিল প্রিয়াঙ্কা! একটু চুপ থেকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন “রেসাল্ট কেমন হল রে বাবু?” এরপর ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ পেলেন ফোনের ওপার থেকে! তাড়াতাড়ি করে ফের বললেন “ আরে কাঁদছিস কেন রে বোকা মেয়ে! এইটুকুতে বার বার করে এত ভেঙ্গে পড়লে অনেক উপরে কিভাবে যাবি বাবু? কান্না থামা!” মায়ের কথাটা শুনে কান্নাটা একটু থামল প্রিয়াঙ্কার! তারপর কান্না জড়ানো গলায় বলল “ আমি সেকেন্ড হয়েছি মা! ২ পয়েন্টের জন্য ফার্স্ট হতে পারলাম না! কি যে কমতি হচ্ছে সেটাই বুঝতে পারিনা আমি!” বলে আবারও কেঁদে উঠলো। সব শুনে নন্দিনী দেবী বললেন “ আরে তো কি হয়েছে! অল ওভার ফার্স্ট হতে গেলে তো দুটো সেমিস্টারের রেসাল্ট মিলে হতে হবে! পরের সেমিস্টারটা খুব ভাল হবে দেখিস! এখন একদম মন খারাপ করবি না কেমন?” একটু থেমে আবার বললেন “ ফার্স্ট হতে হবে ভেবে পরীক্ষা দিলে ফার্স্ট হওয়া যায়না! ভালভাবে পরীক্ষা দাও! নিশ্চই ভাল করতে পারবে! আর এই সেমিস্টারেও যথেষ্ট ভাল ফল হয়েছে! এবার লক্ষ্য রাখ আরও ভাল করার, নাকি ফার্স্ট হওয়ার! কেমন?” প্রিয়াঙ্কা ফোনটা বেশ কিছুক্ষণ হল রেখে দিয়েছে! মনটাকে স্থির করে! “ প্রিয়া! চল খেতে যাচ্ছি” অনিতার ডাকে চমক ভাঙ্গে প্রিয়াঙ্কার। “ হম! চল” সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে খেতে যাওয়ার জন্য রেডি হয় প্রিয়াঙ্কা।
এরপরের সেমিস্টারগুলোতে প্রিয়াঙ্কা অপ্রতিরধ্য হয়ে ওঠে! না! এরপর আর কখনো সে সেকেন্ড হয়নি! নিজের ডিপার্টমেন্ট এমনকি অল ওভারও অনেক বেশি পয়েন্টে সবার থেকে অনেকখানি এগিয়ে মেরিট লিস্টের টপ পজিসানটাতে প্রত্যেক সেমিস্টারেই প্রিয়াঙ্কা চ্যাটার্জীর নামটাই জ্বলজ্বল করতো! এটাই, ঠিক এটাই তো চেয়েছিল প্রিয়াঙ্কা! তাকে এক নামে কলেজের জুনিয়াররা, সিনিয়াররা, টিচাররা, ব্যাচমেটরা সবাই চিনত। প্রিয়াঙ্কার মনে আরও উদ্যম আসতে শুরু করলো! এরই মাঝে মেডিক্যালের জয়েন্টটা আরও একবার দিয়েছিল সে! পরীক্ষাটাতে উত্তীর্ণ হতে পারলেও কাউন্সিলিংএ সরকারি কলেজ পায়নি! ওই দিকে ভি আর এস নিয়ে নেওয়ার জন্য শেখরবাবুরও বেসরকারিতে মেডিক্যাল পড়ানোর মত সামর্থ্য ছিল না! আর এই ব্যাপারটা উপলব্ধি করেই প্রিয়াঙ্কা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়!এমনিতেও আস্তে আস্তে সে যা যা জিনিসগুলো স্কুলে পড়াকালীন পায়নি, সেগুলো ইঞ্জিনিয়ারিংএ এসে পেতে শুরু করেছে! তাই অনেক কিছু পাওয়ার মাঝে মেডিক্যালের স্বপ্নটাকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় প্রিয়াঙ্কা! অস্ফুটে নিজের মনেই বলে ওঠে “ আমার জন্য মেডিক্যালটা হয়তো ছিলই না!”
এই সময় আবার কলেজে ক্রমবর্ধমান পপুলারিটির জন্য বহু প্রপোসালও আসতে শুরু করে প্রিয়াঙ্কার! কিন্তু এই জিনিসটাই প্রিয়াঙ্কার পছন্দের নয়! ওর মনে হত এইসব মনকে অন্যদিকে পরিচালিত করে! তাই যতটা সম্ভব এসব জিনিসকে এড়িয়ে চলত সে! যদিও ইতিমধ্যেই ওর রুমমেটদের অনেকেই বেশ জোর কদমে প্রেম করতে শুরু করে দিয়েছে! কিন্তু প্রিয়াঙ্কা এসব থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করত! কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক! ভাবনার সাথে ভবিতব্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মিল খায়না! প্রিয়াঙ্কা যখন ফাইনাল ইয়ারে, তখনই তার জীবনে আসে সন্দীপ! সন্দীপ প্রিয়াঙ্কারই ডিপার্টমেন্টের অর্থাৎ কম্পিউটার সাইন্সের! আর প্রিয়াঙ্কা সেই হাতছানিকে চেয়েও অগ্রাহ্য করতে পারেনি!
এরপর এই শেষ বছরে প্রিয়াঙ্কার অনেকটাই পরিবর্তন হয়! যে মেয়ে প্রেম করাকে সময়ের অপচয় মনে করত সেই মেয়ে জোর কদমে প্রেম করতে শুরু করাতে ওর বন্ধুরা বেশ অবাকই হয়েছিল। যাই হোক এসবের মাঝে প্রিয়াঙ্কা পড়াশুনাতে ঢিলে দেয়নি একদমই! কারণ আর যাই হোক জীবনে উপরে ওঠাটাই প্রথম প্রায়োরিটি ছিল প্রিয়াঙ্কার!
দেখতে দেখতে শেষ সেমিস্টারের পরীক্ষা এসে যায়! ক্লাসের সেকেন্ড বয় সুমিত, যে কিনা প্রথম সেমিস্টারে ফার্স্ট হয়েছিল, এবারে বেশ খোশ মেজাজে আছে! ওর এমনকি কলেজের আরও সবার মনে হয়েছিল যে এবার হয়তো প্রিয়াঙ্কা আর টপ করতে পারবে না এইসব প্রেমের চক্করে পড়ে ! যাই হোক পরীক্ষা শেষের দিন যখন সবাই সবার সাথে শেষ বারের জন্য দেখা করতে, গলায় মিলে নিতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই প্রিয়াঙ্কার কাছে একটা মেল আসে! আর সেই মেলটা ছিল ইন্ডিয়ার অন্যতম একটা টপ কলেজের এম বি এর প্রবেশিকা পরীক্ষাতে সফল্ভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার বার্তাবাহক! প্রিয়াঙ্কা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না! অবশেষে টপ কলেজে পড়ার স্বপ্ন তার সত্যি হতে চলেছে!? আনন্দে আত্মহারা হয়ে সে মাকে ফোন করে। “ মা, আমি এম বি এর এন্ট্রান্সটা ক্লিয়ার করে ফেলেছি! কাউন্সিলিংর জন্য কল এসেছে!” অত্যন্ত উৎফুল্লিত হয়ে বলে উঠলো প্রিয়াঙ্কা। নন্দিনী দেবী খুশি হওয়ার থেকেও বেশি স্বস্তি পেলেন এই ভেবে যে অবশেষে মেয়েটা যেরকম চাইছিল সেরকম কলেজ পেতে চলেছে! উনি শেখরবাবুকে খবরটা দেন। উনিও খুশি! অবশেষে বহু বছর পরে মেয়ের গলার আওয়াজে এক অনাবিল আনন্দ অনুভব করেন ওনারা! মেয়ের খুশিতেই বাবা-মার খুশি। তাই বহু বছর পরে আজ মিস্টার আর মিসেস চ্যাটার্জীও বেশ স্বস্তি আর খুশি অনুভব করলেন!
“ অত দূরে গিয়ে পড়ার কি দরকার? কলকাতাতে কি ভাল কলেজ নেই?” বিরক্ত হয়ে বলল সন্দীপ। এটা শুনে হটাত করেই প্রিয়াঙ্কা বেশ রেগে গেল আর প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলো “তুই কে বলার? আমি কি কি ফেস করেছি তুই তার কতটুকু জানিস? আমি আজ এই দিনটার জন্য কত রাত যে চোখের জল ফেলেছি আর সকালে উঠে মনকে শক্ত করে পড়াশুনা চালিয়ে গেছি তার কোন হিসাব নেই! নিজের মতামত নিজের কাছে রাখ” বলে ক্যান্টিন থেকে উঠে বেরিয়ে যেতে গেলে সন্দীপ এসে প্রিয়াঙ্কাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলে “ আরে আমি সেটা মিন করতে চাইনি! দেখ আমি গেটের কোচিং করব কলকাতাতে থেকেই! তুইও গেটের কোচিং করতে পারিস আমার সাথে! কিম্বা যদি এম বি এই করতে চাস তো কলকাতাতেও অনেক স্কোপ আছে! সেই কোন কর্ণাটকে গিয়ে করাটা কি জরুরী? অনেকটা দূর! তাই বললাম! তুই বেকারই আমার উপর রেগে যাচ্ছিস!” প্রিয়াঙ্কা কিছুক্ষণ সন্দীপের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর বলল “ আর কিছু বলবি? তোর আর কিছু মতামত থাকলে এখনই বলে দে! কারণ আজকের পর আর কখনো আমি এসব শুনতে চাইনা! আমি কর্ণাটক যাচ্ছি আর এটাই ফাইনাল। চলি আমি! কালকে হোস্টেল ছাড়ছি, তাই অনেক গোছগাছ করতে হবে! ভাবলাম তোর সাথে কথা বলব যাওয়ার ব্যাপারে! কিন্তু মনে হচ্ছে তুই একটুও খুশি নোস আমি চান্স পেয়েছি বলে!” “তুই ভুল বুঝছিস প্রিয়া আমাকে…” কথাটা শেষ করতে না দিয়েই প্রিয়াঙ্কা ফের বলল “ যাই হোক আর কবে দেখা হবে জানিনা! পরশু আমার যাওয়ার ট্রেন আছে! ভাল থাকিস! পরে ফোন করিস” বলে সন্দীপের উত্তরের অপেক্ষা না করেই ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেল প্রিয়াঙ্কা।
আজ হোস্টেলে শেষ রাত প্রিয়াঙ্কাদের! সারারাত জেগে অনেক গল্প করল ওরা সবাই। ভোরে চলে যাবে প্রিয়াঙ্কা! বাকিরাও সেই দিনই যাবে কিন্তু বেলার দিকে! পুবের আকাশ ফরসা হতে শুরু করলেই প্রিয়াঙ্কা রেডি হতে শুরু করলো! তারপর বেরনোর আগে শেষবারের মত সবাইকে জড়িয়ে ধরে যোগাযোগ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় জানালো! সব রুমমেটদের ছলছল চোখের দিকে তাকিয়েও কেন জানিনা সেইভাবে কান্না আসছিল না প্রিয়াঙ্কার! আসলে ও তো এইখান থেকে কবে বেরবে সেই ভাবনাতেই ৪টে বছর কাটিয়ে দিল! সবাই প্রায় কান্নাকাটি করছে, এমনকি হোস্টেল ওয়ার্ডেন ম্যামও ছলছল চোখে দাঁড়িয়ে আছেন! তাও প্রিয়াঙ্কার দুঃখ হচ্ছিল না কেন জানিনা! বরং একটা চাপা আনন্দ মিশ্রিত উত্তেজনা হচ্ছিল! সেটা যে নতুন হাই স্ট্যান্ডার্ড কলেজে ভর্তি হওয়ার খুশিতে সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা! তাও সবার সামনে কিছুটা দুঃখ তো দেখাতেই হয়! তাই মুখটা শুকনো করেই বেরিয়ে এল প্রিয়াঙ্কা! মেন গেটে বয়েস হোস্টেলের বন্ধুদের সাথে দেখা হল! ওরাও শেষবারের মত বিদায় জানিয়ে যোগাযোগ রাখার আবদার জানাল! প্রিয়াঙ্কা হাসিমুখে সম্মতি জানিয়ে মেন গেট থেকে বেরিয়ে এল রাস্তায়! পিছনে পড়ে রইল তার ৪ বছরের অগুন্তি স্মৃতি! ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে যেতে গিয়ে দেখল সামনে থেকে সন্দীপ আসছে! “ চল ট্রেনে তুলে দিয়ে আসি তোকে!” বলে প্রিয়াঙ্কার ব্যাগটা নিতে গেল সন্দীপ। “ না থাক! দরকার নেই! তুইও বাড়ি যাবি তো আজকে! এখন হাওড়া অব্দি গেলে আর কখন ফিরবি হোস্টেলে আর কখনই বা বাড়ি যাবি! ছেড়ে দে! আমি চলে যাব!” বলে প্রিয়াঙ্কা এগোতে শুরু করল। সন্দীপ পিছন পিছন ছুটে এসে প্রিয়াঙ্কাকে থামাল আর বলল “ তোকে সেসব ভাবতে হবে না! চল আমি সাথে যাচ্ছি! আর কালকে সাবধানে যাস! আঙ্কেল আন্টি সাথে যাচ্ছেন তো?” প্রিয়াঙ্কা এবার হাল্কা হেসে বলল “ হম মা-বাবা দুজনেই যাচ্ছে।“ সন্দীপ হেসে প্রিয়াঙ্কার ব্যাগগুলো তুলে নিয়ে বাস স্টপের দিকে এগোতে শুরু করল আর প্রিয়াঙ্কা পিছন পিছন হাঁটা শুরু করলো।
Suspense Thriller
চতুর্থ পর্ব
মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে প্রিয়াঙ্কা! কলেজ ক্যাম্পাস তো নয় যেন একটা স্বপনপুরি, যেখানে আসার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল সে! সব কিছুই একটা অবাস্তব স্বপ্নের মত মনে হচ্ছিল প্রিয়াঙ্কার! আর সাথে একটা উত্তেজনা মিশ্রিত ভয়ও কাজ করছিল! ভয়টা লাগছিল এখানে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে কিনা সেই চিন্তাতে! কলেজের কাউন্সিলিং শেষে পুরো ক্যাম্পাসটা ঘুরে দেখছিল প্রিয়াঙ্কারা! চারপাশে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টাল বিল্ডিংস! এখানে শুধু এম বি এই নয় বরং আরও অনেক রকম ডিপার্টমেন্টস আছে! যেমন বিটেক, এমটেক, বিসিএ, এমসিএ, বিএসসি, এমএসসি ইত্যাদি! চারপাশটা দেখতে দেখতে আবিষ্ট হয়ে পড়ছিল প্রিয়াঙ্কা! কলেজ ক্যাম্পাসটা একটা ছোটখাটো টাউন বললেও ভুল করা হবে না! কিছুদূর পর পরই ফুড কোর্ট, আইসক্রিম হাব আরও কত কি! একটু বাঁক নিতেই চোখে পড়ল একটা বিশাল বাস্কেট বল গ্রাউনড! এখন ক্যাম্পাসের মধ্যে দিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটছে প্রিয়াঙ্কারা! ক্যাম্পাসের মধ্যেও কিছু ক্যাব যাওয়া আসা করছে! অনেকে সাইকেল নিয়েও যাচ্ছে আসছে! প্রিয়াঙ্কার বাবা জিজ্ঞেস করে জানলেন যে অনেক বড় ক্যাম্পাস হওয়ায় এখানে কিছু ক্যাবও চলে ক্যাম্পাসের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাওয়ার জন্য! আর এই ক্যাবগুলো কলেজের জন্যই রাখা, বাইরের কোন গাড়ি পারমিশন ছাড়া ভিতরে ঢুকতে পারে না! আর যারা লোকাল, তারা নিজের গাড়ি বা সাইকেল নিয়ে আসতে পারে! সবের জন্যই আলাদা আলাদা পারকিং জোন আছে! আরও খানিকটা এগিয়ে একটা বিশাল স্টেজ আর সংলগ্ন ফুলের বাগান চোখে পড়ল ওদের! এমনিতেও পুরো ক্যাম্পাসটাই অসম্ভব পরিস্কার পরিছন্ন! আর সাথে প্রতিটা জায়গায় বিভিন্ন জানা-অজানা ফুলের ছোট বড় বাগিচা রয়েছে! কিন্তু এই বাগানটা একটু বেশিই বড় মনে হল! “এখানে মনে হয় ফেসট হয় বুঝলে মা! দেখ জায়গাটা বেশ বড় অন্য বাগানগুলোর তুলনায়! আর একটা বিশাল ওপেন স্টেজও আছে তাই না?” মায়ের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো প্রিয়াঙ্কা! নন্দিনী দেবী একটু থেমে বললেন “ এখানে এত কিছু রয়েছে, কোনটা যে কিসের জন্য বলা মুশকিল! তুই থাকবি তো তখনই সব বুঝতে পারবি!” “এবার আমরা হোস্টেলটা দেখি গিয়ে কেমন! ক্যাম্পাসটা দেখার আরও অনেক সময় পাওয়া যাবে! এমনিও একদিনে দেখে শেষ করা সম্ভব নয়!” হেসে বললেন শেখরবাবু। বাবার কথায় সম্বিত ফেরে প্রিয়াঙ্কার! ঠিকই তো! হোস্টেল দেখতে হবে, শিফটও তো করতে হবে! লাগেজগুলো সব অফিসের রুমে রাখা আছে! সত্যি! চারপাশটা দেখতে দেখতে সব ভুলতে বসেছিল সে! নিজের মনেই হেসে উঠলো প্রিয়াঙ্কা!
মেয়েকে এতটা খুশি দেখে প্রিয়াঙ্কার বাবা-মাও ভীষণ খুশি! আর তাদেরও কলেজ ক্যাম্পাসটা খুবই পছন্দ হয়েছে! আরও বেশি পছন্দ হয়েছে মেয়ের খুশি দেখে! পায়ে পায়ে লাগেজগুলোকে নিয়ে কলেজের ফিমেল হোস্টেলের পথে এগিয়ে চলল ওরা। এখানে যারা পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করতে আসে তাদের হোস্টেল আর আন্ডার গ্র্যাজুয়েশনদের হোস্টেল এক নয়! পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনদের ফিমেল হোস্টেলটা কলেজ ক্যাম্পাসের একটু অন্য দিকে! অফিস থেকে ডায়রেকশন নিয়ে ওরা যখন হোস্টেলে এসে পউছাল তখন দুপুর হয়ে গেছে! হোস্টেলের সামনে সব মেয়েরা লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে কুপন হাতে! কাউন্সিলিংর শেষে হোস্টেলারদের সবাইকে একটা করে কুপন দেওয়া হয়েছিল যেখানে তাদের হোস্টেলের রুম আর বেড নাম্বার মেনশেন করা আছে! প্রিয়াঙ্কাও লাইনে গিয়ে দাঁড়ায়! মনে মনে ভাবতে থাকে যে আগের কলেজে তো এসবের বালাই ছিল না! যে যেমন যাচ্ছে সেরকম হোস্টেলে ঢুকে যাচ্ছে! এখানে সব কিছুই নিয়ম মেনে হয়! নিয়মের বাইরে কিচ্ছু হয়না! প্রিয়াঙ্কার চারপাশের বেশিরভাগ মেয়েই দক্ষিণ ভারতীয়! তাই বিশেষ কিছু কথা বলতেও সাহস হচ্ছেনা প্রিয়াঙ্কার! এমনিতেও প্রিয়াঙ্কা অন্তর্মুখী! কিন্তু তা সত্ত্বেও মিশতে ভালই পারে সবার সাথে! কিন্তু রাজ্যের বাইরে প্রথম এল পড়তে! তাই ভিনরাজ্যের মানুষদের সাথে কিভাবে মানিয়ে নেবে সেটা নিয়ে বেশ একটু ভয় ভয়ই করছে তার! তার উপর শুনেছে এখানে সব কিছুই অনলাইন! মানে পড়াশুনা থেকে শুরু করে সব কিছু! আর এতটা অনলাইনে অভ্যস্তও নয় সে! সব কিছু সামলে সবার আগে এগিয়ে থাকতে পারবে তো সে? লাইনে দাঁড়িয়ে এসবই ভাবছিল প্রিয়াঙ্কা ঠিক তখনই নন্দিনী দেবী একটা বেশ গোলগাল মেয়েকে সাথে করে এগিয়ে এলেন প্রিয়াঙ্কার কাছে। “ পিউ! দেখ এ হল নিবেদিতা! নিবেদিতা সেন! সেম ডিপার্টমেন্ট তোর সাথে! কলকাতাতে বাড়ি ওর!” হেসে বললেন নন্দিনী দেবী। “ হাই প্রিয়াঙ্কা! তোর কি ব্লক বি?” মিষ্টি হেসে বলল নিবেদিতা।“ হ্যাঁ রে! আর তোর?” জিজ্ঞেস করল প্রিয়াঙ্কা। “আমার ব্লক এ! আমার তো রুমে শিফটিংও হয়ে গেল! তোদের ব্লকের লাইনটা একটু বেশিই বড় মনে হচ্ছে!” হেসে হেসে বলল নিবেদিতা। “ হম রে! তাই মনে হচ্ছে! এই দুটোই তো ব্লক! তার উপর সব মেয়েদের মনে হয় আমাদের ব্লকেই দিয়েছে!” হাসতে হাসতে বলল প্রিয়াঙ্কা। এরপর কথায় কথায় জানলো যে নিবেদিতাও বিটেক করেছে তবে প্রিয়াঙ্কার এক বছর আগে পাশ-আউট। এক বছর বিভিন্ন কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়েছে, কিন্তু কোথাও কিছু না হওয়ার অবশেষে এম বি এ করতে এসেছে! নিবেদিতাও কম্পিউটার সাইন্স নিয়েই পড়েছে! কাজেই এক লহমায় দুজনের বন্ধুত্ব হয়ে গেল! ফর্সা, গোলগাল চেহারার সিধাসাধা মেয়ে নিবেদিতাকে প্রিয়াঙ্কার খুব ভাল লেগে যায়। দুজনের মধ্যে সেইদিন থেকেই একটা সুন্দর বন্ধুত্ব হয়ে গেল! নন্দিনী দেবী আর নিবেদিতার মা, গৌরিদেবীও বেশ নিশ্চিন্ত হলেন এই দূর রাজ্যে এসে দুই বাঙালি মেয়ের প্রথমদিনেই বেশ ভাল বন্ধুত্ব হয়ে যাওয়াতে!
“ হাই নিবেদিতা!” সকালে ক্যান্টিনে ঢুকতে ঢুকতে হাত দেখাল প্রিয়াঙ্কা। নিবেদিতাও হাত নেড়ে ওকে নিজের কাছে ডাকল। প্রিয়াঙ্কা তিনটে ব্রেড, একটা অমলেট, আর কফির কাপটা কাউনটার থেকে নিয়ে নিবেদিতার পাশে এসে বসলো। “তোর রুম নাম্বার কত?” খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো নিবেদিতা। “ ১১১ রে! গ্রাউন্ড ফ্লোর। তোর তো সেকেন্ড ফ্লোর না?” ব্রেডে কামড় দিতে দিতে বলল প্রিয়াঙ্কা। “ হম রে! রুম নাম্বার ৩০১। তোদের ব্লকটাই বেশি ভাল জানিস তো! আমাদের ব্লকটা পুরনো! আর ক্যান্টিনটাও এই ব্লকেই! আমি ভাবছি শিফট করে নেব ব্লক বি তে! দেখি আজ কলেজ থেকে ফিরে ওয়ার্ডেনের সাথে কথা বলব” বলে কফিতে চুমুক দিল নিবেদিতা। “ আরে তো খুবই ভাল হয় তাহলে! চলে আয় এই ব্লকে! একসাথে পড়াশুনা করা যাবে!” আনন্দিত হয়ে বলল প্রিয়াঙ্কা। নিবেদিতা স্মিত হেসে বলল “চল এবারে! দেরি হয়ে যাবে নয়তো! আজকে তো মনে হয় ক্লাস হবে না! ইনগরেশন প্রোগ্রামের পর ক্লাসের শিফট বুক করতে হবে!” “শিফট বুক মানে?” বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো প্রিয়াঙ্কা। “ যেতে যেতে বলছি চল! নইলে দেরি হয়ে যাবে!” বলে হাত ধুতে উঠে পড়ল নিবেদিতা।
“ম্যানেজমেন্টের সেমিনার হলটা কোনদিকে হবে কি জানি! এখানে এত বিলডিংস যে খুঁজে পাওয়াও মুশকিল! আমার তো মনে হচ্ছে হারিয়ে যাব!” হেসে হেসে বলল প্রিয়াঙ্কা। “ আমি আসলে কাউন্সিলিংর দিন সেমিনার হলটা বাইরে থেকে দেখেছিলাম! মনে হয় ওই সেমিনার হলটাই হবে! চল না খুঁজে পেলে গার্ডগুলোকে জিজ্ঞেস করে নেওয়া যাবে!” হাঁটতে হাঁটতে বলল নিবেদিতা। এরপর আর কিছু না বলে দুজনেই পা চালাল। ভাগ্য ভাল ছিল তাই একজন গার্ডকে জিজ্ঞেস করেই সেমিনারে সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেল দুজন।
“ক্লাসের শিফট বুকিংটা কি বলছিলিস যেন! আমি তো এরকম কিছু শুনিনি!” সেমিনারের মধ্যে ফিসফিস করে বলল প্রিয়াঙ্কা। “ আরে আমার একজন পরিচিত এম বি এ করেছিল এখান থেকেই! সেই বলেছিল যে প্রথম দিন ইনগরেশনের প্রোগ্রামের পর একটা অনলাইনে ক্লাসের শিফট বুকিং হয়! মানে তুই কোন সময়ে ক্লাস করতে চাস সেটা অপসানে থাকা শিডিউল অনুযায়ী বেছে নিতে পারিস। প্রায় সব বিষয়ের ক্ষেত্রেই এটা করা যাবে!” বলল নিবেদিতা। প্রিয়াঙ্কা বেশ রোমাঞ্চ ফিল করল। নিজের সুবিধামত ক্লাসের সময় বাছা যায় এটা সে জানত না! এখান থেকে যদি বি টেকটাও করা যেত কতই না ভাল হত! আরও কতকি সে শিখতে আর জানতে পারত! এখানের সব কিছুই ভীষণ স্ট্যান্ডার্ড! ঠিক যেমনটা প্রিয়াঙ্কার পছন্দ। মানুষের চাওয়াটা কি এতটা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যেতে পারে? বিস্ময় লাগে প্রিয়াঙ্কার! এক মনোমুগ্ধকর বিস্ময়তা!
এরপর সেদিনের মত সেমিনার শেষে ক্লাস শিডিউল বুক করল ওরা সবাই। নিজেদের ডিপার্টমেন্টের বাকি ক্লাসমেটদের সাথে পরিচয় হল। এদের অনেকেই যে প্রিয়াঙ্কারই ব্লকেই থাকে সেটাও জানতে পারলো সে! আর একজন বাঙালি মেয়ের সাথে পরিচয় হল। মেয়েটা প্রিয়াঙ্কাদেরই ডিপার্টমেন্টের, নাম মধুমন্তি দাস। মধুমন্তিও ইঞ্জিনিয়ারিং করেছে কিন্তু ইলেক্ট্রিক্যালে! কথায় কথায় জানা গেল মধুমন্তিও ব্লক বি তেই রয়েছে, ফার্স্ট ফ্লোর ওর! বেশ ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গেল তিনজনের ওইদিনই!
সকালে তাড়াহুড়ো থাকায় সেইভাবে নিজের রুমমেটদের সাথে কথা হয়ে ওঠেনি প্রিয়াঙ্কার। কলেজ শেষে সবাই গল্প করতে শুরু করল। প্রিয়াঙ্কার রুমে প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে চারজন। এর মধ্যে একজন গোয়া থেকে এসেছে, নাম মাধুরি, একজন কেরালার, নাম স্মৃতি, আর একজন তামিলনাডুর, নাম অর্চনা। এদের মধ্যে মাধুরি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংএ এম টেক করছে, স্মৃতি ইলেক্ট্রনিক্সে এম টেক করছে, আর অর্চনা এম সি এ করছে। সবার সাথে আলাপ হল বেশ ভালভাবে। হোস্টেলটা খুবই পরিস্কার পরিছন্ন! সবসময়ই ক্লিনিং হয়! আর প্রিয়াঙ্কাদের রুমটা বেশ সুন্দর। প্রত্যেকের নিজস্ব আলমারি দেওয়া আছে, তার সাথে স্টাডি টেবিল, চেয়ার সব কিছু! আর রুমটা পুরো এসি! প্রিয়াঙ্কার মনে পড়ে আগের কলেজের হোস্টেলের কথা! ক্লিনিংএর কোন শিডিউলই ছিলনা! দুটো টেবিল চারজনকে শেয়ার করতে হত! আর টপ ফ্লোরে রুমটা হওয়ায় গরমকালে প্রাণ বেরিয়ে যেত! তখন আরও বেশি কান্না পেত প্রিয়াঙ্কার! গরমের জন্য ঠিক না! বরং এইরকম কলেজে আর হোস্টেলে পড়তে হচ্ছে সেটা ভেবেই বেশি কান্না আসতো! এখানের ক্যান্টিনের খাওয়ারও বেশ ভাল! শুনেছে খাওয়ার রিপিট হয়না! আর আগের কলেজের হোস্টেলের খাওয়ারের কথা ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায় তার! আধা দিনতো ঠিক করে খেতেই পারতোনা প্রিয়াঙ্কা! মাঝে মাঝে রেস্তোরা থেকে আনাত, কিন্তু কদিন? চারটে বছর কম ছিল না! যা দিন পেরিয়ে এসেছে সে, আর সেদিন দেখতে হবে না! এসব ভাবতে ভাবতে বিছানা করল প্রিয়াঙ্কা! বাকিরা শুয়ে পড়েছে! কাল থেকে ক্লাস শুরু! নিবেদিতা বলছিল এখানের লাইব্রেরিটা একদম বিদেশী ধাঁচের! উত্তেজনায় এখনি একবার দেখতে যেতে ইচ্ছা করছিল প্রিয়াঙ্কার। নিজের উত্তেজনাকে সামলে লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো প্রিয়াঙ্কা। “ কালকে নতুন দিন! নতুন সকাল! আর আগের কথা ভাববো না…” ভাবতে ভাবতেই দেখল ফোনটা ভাইব্রেট করছে! তুলে নিয়ে দেখল সন্দীপ। রিসিভ করে বলল “ আমি এখন শুতে যাচ্ছি রে! খুব ক্লান্ত! কালকে কলেজ থেকে ফিরে কথা হবে কেমন? বাই!” বলে ফোনটা রেখে শুয়ে পড়ল প্রিয়াঙ্কা। মনে এক একরাশ উত্তেজনা আর ভাললাগার আবেশ নিয়ে চোখ বুজল সে।
Suspense Thriller
পঞ্চম পর্ব –
এরপর কলেজের দিনগুলো স্বপ্নের মত কাটতে শুরু করলো। আস্তে আস্তে সবকিছুর সাথে বেশ ভালমতোই পরিচিত হতে থাকে প্রিয়াঙ্কা! নিবেদিতা অনেক কিছু বেশি জানতো প্রিয়াঙ্কার থেকে, তাই ওর সাহায্যে আর নিজের অদম্য চেষ্টাতে কিছুদিনের মধ্যেই কলেজের প্রায় সবরকম নিয়ম আর পড়াশুনার ধরন আয়ত্ত করে ফেলে সে। দেখতে দেখতে প্রায় এক মাস পূর্ণ হয়। এই এক মাসে ক্লাসের সাথে সাথে প্রিয়াঙ্কা, নিবেদিতা প্রায় সব ফুডকোর্ট, আইসক্রিম হাব আর সাথে ক্যাম্পাসের ঠিক বাইরের বিশাল শপিং মলটাকে অগুন্তি বার চষে ফেলেছে। মধুমন্তিও মাঝে মাঝে ওদের সঙ্গ নিত! কিন্তু মধুমন্তি মেয়েটা বড্ড অলস! তাই বেশির ভাগ দিন ক্লাসের শেষে অথবা ছুটির দিনে ওরা দুজনই বেড়িয়ে পড়তো ক্যাম্পাসটাকে চষে বেড়াতে! আর তার সাথে কলেজের অ্যাডভান্সড পড়াশুনার সিস্টেম! এত চমৎকার লাগতো ক্লাস করতে প্রিয়াঙ্কার যে ক্লাসেই অর্ধেক পড়া হয়ে যেত! অডিও ভিসুয়াল ক্লাসগুলো করতে করতে মন ভরে যেত প্রিয়াঙ্কার! চমৎকারভাবেই সব কিছু চলছিল। কিন্তু বলতেই আছে কোনকিছুই এই পৃথিবীতে স্থায়ী নয়! এরপর এমন কিছু একটা হতে চলেছিল প্রিয়াঙ্কার জীবনে যার কল্পনা করা কারুর পক্ষেই সম্ভব নয়!
ক্লাসে ঢুকতে গিয়ে একটা নতুন মুখ চোখে পড়ল প্রিয়াঙ্কার। মেয়েটা হিজাব পড়ে ক্লাসের প্রথম বেঞ্চে বসে আছে। দেখেই বোঝা গেল যে মেয়েটা মুসলিম। কিন্তু মেয়েটা অদ্ভুতভাবে হেসে হাত নাড়াল প্রিয়াঙ্কাকে দেখে! প্রথমে প্রিয়াঙ্কা বুঝতে পারেনি কাকে হাত দেখাল মেয়েটা, কারণ মেয়েটাকে চেনে বলে তো মনে হচ্ছে না! তারপর যখন মেয়েটা সামনে উঠে এসে পরিস্কার ইংলিশে বলল “ হাই! কেমন আছো?” তখন বেশ অবাক হয়ে গেল সে! কোন কিছু জবাব দেওয়ার আগেই ক্লাসে টিচার ঢুকলেন। তাই তখনকার মত মেয়েটি ওইরকম ভাবেই হাসি মুখে নিজের জায়গায় ফিরে গেল।
“ এই শোন না, বলছি আমাকে একটু লাইব্রেরী যেতে হবে বুঝলি? তুই বরং রুমে চলে যা, আমি বইগুলো সাবমিট করে ডায়রেকট তোর রুমে চলে আসব। তারপর বিকেলের টিফিনটা করে প্রেজেন্টেশনটা নিয়ে বসব একসাথে কেমন?” ক্লাস শেষে কলেজ বিল্ডিং থেকে বেরতে বেরতে বলল নিবেদিতা। প্রিয়াঙ্কা দেখল ঘড়িতে সাড়ে চারটে বাজে। বিকেলের টিফিন আওয়ারস হতে এখনো আধ ঘণ্টা মত বাকি! তাই ভাবল একটু হোস্টেলে গিয়ে বিশ্রাম করে নিলে মন্দ হয়না! এমনিতেও প্রেজেন্টেশনের কাজ করতে করতে অনেক রাত হবে। তাই নিবেদিতার কথায় সম্মতি জানিয়ে হোস্টেলের দিকে পা বাড়াল প্রিয়াঙ্কা।
হোস্টেল বিল্ডিংএ ঢুকে নিজের রুমের সামনে আজকে সকালে ক্লাসে দেখা মেয়েটাকে দেখে একটু অবাকই হল প্রিয়াঙ্কা। মেয়েটা সেই একই রকম হাসি মুখে রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সামনাসামনি এসে পড়াতে প্রিয়াঙ্কাও হাল্কা হাসল। এবার মেয়েটা এগিয়ে এসে ইংলিশে বলল “প্রিয়াঙ্কা রাইট? হ্যালো, আমি আসিফা, গুজরাট থেকে এসেছি। একটু দেরী হয়ে গেল ক্লাস জয়েন করতে! আর তোমার বাড়ি কোথায়?” প্রিয়াঙ্কা একটু চুপ করে থেকে বলল “ আমি ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে এসেছি। বাই দা ওয়ে, তুমি আমার নাম জানলে কি করে? না মানে কলেজে রোল কল তো হয়না এখানে! বায়মেট্রিক অ্যাটেনডেন্স হয়! তাই ভাবছিলাম আর কি…… আর এখানে হটাত?” আসিফা আবারও সেরকমই হাসি মুখে বলল “ আরে ভর্তির সময় অফিসে দেখেছিলাম তোমার নামটা, আমার জাস্ট পরের রোল নাম্বারটাই তোমার, তাই নামটা মনে থেকে গেছে! আর এখানে এসেছি কারণ রুম নাম্বার ১১০ হল আমার রুম, শিফট করলাম আজই।“ প্রিয়াঙ্কা আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। একটা খটকা লাগছিল মনে! নামটা না হয় ভর্তির সময় দেখেছে তাই মনে থেকে গেছে, কিন্তু সেই নামের মেয়েটা যে সেই সেটা বুঝল কিভাবে? প্রিয়াঙ্কা নামের আরও মেয়ে থাকতে পারে সেম ক্লাসে! আর প্রথমেই সেই উঠে এসে কথা বলাটা কেমন যেন অদ্ভুত লেগেছিল প্রিয়াঙ্কার। এমনভাবে কথা বলেছিল যেন বহুদিনের পরিচিত! এসব ভাবতে ভাবতেই দেখে নিবেদিতা ওর রুমে ঢুকছে! “কি রে যাবিনা খেতে?” ব্যাগটা প্রিয়াঙ্কার বেডে নামিয়ে রেখে বলল নিবেদিতা। প্রিয়াঙ্কা মাথা নেড়ে বলল “চল।“
প্রিয়াঙ্কা অন্যমনস্ক হয়ে আছে দেখে থাকতে না পেরে এবার জিজ্ঞেস করেই ফেলল নিবেদিতা “ কিরে? কিছু হয়েছে নাকি? এনিথিং পার্সোনাল?” প্রিয়াঙ্কা চমক ভাঙ্গার মত চমকে তাকায় নিবেদিতার দিকে। তারপর একটু সামলে নিয়ে বলে “ আজকে ক্লাসের নতুন মেয়েটাকে দেখলি? আমার বেশ অদ্ভুত লাগলো ওকে!” “কোন মেয়েটা?” নিবেদিতা ল্যাপটপ থেকে চোখ না সরিয়েই জিজ্ঞেস করলো। “ আরে হিজাব পড়া মুসলিম মেয়েটা রে! যেচে এসে কথা বলল!” বলল প্রিয়াঙ্কা। “ও আচ্ছা ঐ মেয়েটা! ওকে আজকে তোদের ব্লকেই দেখলাম তো!” বলল নিবেদিতা। “ আমার পাশের রুমটাতেই তো আছে! আমার সাথে দেখা হয়েছিল যখন তুই লাইব্রেরী গেছিলিস তখন! যেচে যেচে কথা বলছিল। আমার কিন্তু কেমন যেন একটা লাগলো ওকে!” আস্তে আস্তে বলল প্রিয়াঙ্কা। “ কিরকম?” ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে জিজ্ঞেস করল নিবেদিতা। “হম…ছাড় এসব! চল প্রেজেন্টেশনটা রেডি করি। একটু বেশিই ভাবছি মনে হয়!” বলে কাজে মন দিল প্রিয়াঙ্কা। নিবেদিতাও আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না।
কিছুদিনের মধ্যেই বোঝা গেল আসিফা মেয়েটা যথেষ্ট মেধাবী। ক্লাসে প্রায় সবরকম কোয়েশ্চন-আনসারিং সেশনে প্রিয়াঙ্কা আর আসিফা পার্টিসিপেট করে! দেখতে দেখতে কলেজের প্রথম ইন্টারনাল পরীক্ষা এসে গেল। এই সময় যথেষ্ট পড়াশুনা করছে প্রিয়াঙ্কা! ওকে সব পেপারে সর্বোচ্চ নাম্বার আনতেই হবে! এটা কলেজের প্রথম পরীক্ষা, তাই প্রথম ইম্প্রেশনটা খুব ভাল রাখতেই হবে! প্রিয়াঙ্কা বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছে যে আসিফা মাঝে মাঝেই তার স্বভাবসিদ্ধ হাসিটা ছেড়ে কেমন যেন ঘোলা নজরে তাকিয়ে থাকে তার দিকে! বিশেষ করে যখন ক্লাসে কোন প্রশ্নের উত্তর প্রিয়াঙ্কা আসিফার আগে দিয়ে দেয় কিম্বা প্রিয়াঙ্কার প্রেজেন্টেশন কোনভাবে একটু বেশি বাহবা পেয়ে যায় ঠিক তখন! সেই সময় আসিফাকে দেখে একটু কেমন যেন লাগে প্রিয়াঙ্কার! এসব তার মনের ভুল কিনা সে জানেনা কিন্তু আসিফা এখন সেই প্রথম দিনের মত ঠিক করে কথা বলেনা আর প্রিয়াঙ্কার সাথে। কারণটা হয়ত প্রিয়াঙ্কার জানা! ক্লাসে প্রিয়াঙ্কা এগিয়ে যাচ্ছে সেটা ভেবে হয়তো হিংসায় কথা বলেনা! হিংসা প্রিয়াঙ্কারও হয়! যে ওকে বিট করার চেষ্টা করে তার উপরই একটা হিংসাতো হয়ই! কিন্তু আসিফার ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হয়না প্রিয়াঙ্কার! সবসময় সেই এক যুদ্ধজয়ের মত প্রচেষ্টা আসিফার! এতটা কংক্রিট মনোভাব তো প্রিয়াঙ্কারও নয়! নিবেদিতাকে বলেছিল একবার। ও বলল “ তোরা দুজন কম্পিটিটারস! সেটা প্রথমদিন বোঝেনি মনে হয়! এখন বুঝে আর কথা বলছে না! হিংসুটে মেয়ে!” ব্যাপারটা কেন জানিনা এতটাও সহজ মনে হয়না প্রিয়াঙ্কার!
আজকে শেষ পরীক্ষা ছিল প্রথম ইন্টারনালের। গল্প করতে করতে মধুমন্তি, প্রিয়াঙ্কা আর নিবেদিতা হোস্টেলে ফিরছিল। হোস্টেলে ঢোকার মুখে আসিফার সাথে দেখা! তাকে সেই তার স্বভাবসিদ্ধ হাসিমুখে দেখা গেল। ওদের দেখে নিজেই এগিয়ে এল। “ কেমন হল পরীক্ষা?” মুখে হাসি বজায় রেখেই জিজ্ঞেস করল আসিফা। “ সেরকম ভাল না। ওই হল একরকম। তোমার কেমন হল?” জিজ্ঞেস করল মধুমন্তি। মধুমন্তির কথার জবাব না দিয়েই হাসি মুখেই প্রিয়াঙ্কার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল আসিফা “ প্রিয়াঙ্কা তোমার কেমন হল? নিশ্চয়ই খুব ভাল?” প্রিয়াঙ্কা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল “ হয়েছে ভালই।“ আসিফা হাল্কা হেসে বলল “ আমারও হয়েছে একরকম। আচ্ছা চলি, নমাজের টাইম হচ্ছে!” বলে তাড়াতাড়ি করে হোস্টেলের ভিতরে ঢুকে গেল আসিফা। “এই মেয়েটার মাথার ডিফেক্ট আছে মনে হয় বুঝলি? আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে সেদিন নিখিলের বার্থ ডে সেলিব্রেট করা হল, আসিফাকে আমি আর রিদিমা ডাকতে এসেছিলাম। কত করে বললাম তাও এলনা! বলে নাকি ওর এসব ভাল লাগেনা!” মুখ বেঁকিয়ে বলল মধুমন্তি। প্রিয়াঙ্কা আর কিছু বলল না।
এরপর আবার আগের মতই আসিফা এক মুখ হেসে কথা বলতে শুরু করল প্রিয়াঙ্কার সাথে। প্রিয়াঙ্কা যদিও হম, হ্যাঁ ছাড়া বিশেষ জবাব দিতনা। ইয়ার্কি নাকি! যখন মন হবে কথা বলবে, যখন মন হবেনা তখন কথা বলবেনা! যাই হোক সবকিছুই আবার আগের মত চলতে শুরু করল। এর মাঝে একদিন প্রিয়াঙ্কার বাবা-মা দেখা করতে এলেন। ভিসিটিং রুমে বসে কথা বলছিল প্রিয়াঙ্কা বাবা-মার সাথে, হটাত করে দেখে আসিফা রুমে ঢুকছে। প্রিয়াঙ্কা ভাবল হয়তো ওরও গার্জেন দেখা করতে এসেছেন! কিন্তু প্রিয়াঙ্কাকে একপ্রকার চমকে দিয়ে আসিফা সেই হাসিমুখে প্রিয়াঙ্কার বাবা-মার সামনে এসে বলল “ হ্যালো আঙ্কেল, হ্যালো আন্টি! কেমন আছেন আপনারা? কবে এলেন?” প্রিয়াঙ্কা অসম্ভব অবাক হয়ে গেল। আসিফার কথা বলার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে যেন প্রিয়াঙ্কার বাবা-মাকে কতদিন ধরে চেনে! ঠিক যেমন প্রিয়ঙ্কাকে প্রথম দিন দেখে কথা বলেছিল! প্রিয়াঙ্কা এই আসিফার অযাচিত আগমনে বেশ বিরক্ত হল। এমনিতেই প্রায় ২.৫ মাস পরে বাবা-মার সাথে দেখা হয়েছে তার উপর না ডাকতেই এসে হাজির হয়েছে এ! অদ্ভুত মেয়ে তো! যাই হোক না চাইতেও বাবা-মার সাথে আসিফার পরিচয় করিয়ে দিতে হল। কথায় কথায় বলল আসিফা যে ও ইঞ্জিনিয়ারিংই করেছে। গেটের জন্য এক বছর খেটেও সেরকম ভাল ফল হয়নি। তাই শেষে এম বি এ করতে এসেছে। নন্দিনী দেবী টুকটাক কথা জিজ্ঞেস করলেন আসিফাকে। আসিফা যে বিটেক করেছে সেটাই আজ জানলো প্রিয়াঙ্কা। আসলে জানার চেষ্টা করেনি! আসিফা ক্লাসের কারুর সাথেই সেইভাবে মেশেনা। একা একাই থাকে। মাঝে মাঝে একজন রুমমেটের সাথে ক্যান্টিনে খেতে আসে, নয়ত একাই আসে বেশিরভাগ দিন। যাইহোক বেশ কিছুক্ষন কথা বলে আসিফা বিদায় নিল। প্রিয়াঙ্কার ভেবে অবাক লাগছিল যে মেয়ে কোন ইভেন্টে যায়না সে আজ না ডাকাতেই ওর বাবা-মার সাথে দেখা করতে চলে এসেছে! আচ্ছা জানলো কি করে যে ওর বাবা-মা এসেছে? মনে মনে ভাবছিল প্রিয়াঙ্কা। এদিকে ভিসিটিং আওয়ারস শেষ হয়ে গেছিল তাই প্রিয়াঙ্কার বাবা-মাও তখনকার মত বিদায় নিয়ে পার্শ্ববর্তী হোটেলের পথে পা বাড়ালেন। প্রিয়াঙ্কাও তখনকার মত নিজের রুমে চলে এল।
সেই রাতে একটু বেশিরাত অব্দি পড়াশুনা করছিল প্রিয়াঙ্কা। রাত প্রায় ১.৩০ বাজে তখন। এবার শুয়ে পড়বে ভেবে বাথরুমে যাওয়ার জন্য রুম থেকে বেরোল প্রিয়াঙ্কা। বাথরুমটা প্রিয়াঙ্কার রুম থেকে একটু দূরে। প্রিয়াঙ্কার রুমে স্মৃতি ছাড়া বাকি সবাই শুয়ে পড়েছে ততক্ষণে! প্রিয়াঙ্কা বাথরুমের কাছাকাছি আসতে পাশের ব্লকের জানলার দিকে চোখটা গেল ওর। প্রিয়াঙ্কাদের ব্লকটা মানে ব্লক বি আর পাশের ব্লকটা মানে ব্লক এ, দুটো ব্লকই পরস্পরের সাথে লাগানো। বি ব্লকের গ্রাউন্ড ফ্লোরের বাথরুমে ঢোকার মুখে বাঁ হাতি যে জানলাটা পড়ে সেটা ব্লক এর সিঁড়িঘরের জানলা। সেই জানলার দিকে তাকাতেই দেখে যে দুটো মেয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়াঙ্কার দিকে চেয়ে! হটাত করেই বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে প্রিয়াঙ্কার! মেয়েদুটো স্থির দৃষ্টিতে প্রিয়াঙ্কার দিকে তাকিয়ে আছে আর দুজনেই হাত নেড়ে ওকে ডাকছে! প্রিয়াঙ্কা চকিতে সচেতন হয়ে যায় আর চিৎকার করে বলে “ যা বলবে ওখান থেকেই বল!” ঠিক সেইসময়েই পিছন থেকে কিছু মেয়ের কথার আওয়াজ আসাতে পিছন ফিরে তাকায় প্রিয়াঙ্কা। দেখে তিনজন মেয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে বাথরুমের দিকেই আসছে! তারপর আবার জানলার দিকে ঘুরে দেখে কেউ নেই! প্রিয়াঙ্কার গলা একদম শুকিয়ে যায়। তাড়াতাড়ি বাথরুম থেকে ঘুরে প্রায় দৌড়ে রুমের দরজার কাছে এসে থামে। ঠিক তখনই পাশের রুমের দরজায় দেখে আসিফা দাঁড়িয়ে আছে! মুখে সেই স্বভাবসিদ্ধ হাসিটা নেই। এই অবস্থায় আসিফাকে সেই আলো আধারিতে দেখে চমকে যায় প্রিয়াঙ্কা! আসিফা বেশ গম্ভীরভাবে প্রিয়াঙ্কার সামনে দিয়ে বাথরুমের দিকে চলে গেল। প্রিয়াঙ্কা বেশ অবাক হয়েছে আর সাথে ভয়ও পেয়েছে! আর কোনদিকে না তাকিয়ে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল প্রিয়াঙ্কা। রুমের সবাই ঘুমিয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। প্রিয়াঙ্কা কোনরকমে নিজের বেডে এসে চোখ বন্ধ করে ঘুমনোর চেষ্টা করতে লাগলো।